আমার জীবনের লক্ষ্য - রচনা
আমার জীবনের লক্ষ্য
সূচনাঃ মানবজীবনের ক্ষণস্থায়ী। এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে তার অনেক আশা, অনেক প্রত্যাশা। জীবনটাকে মানুষ চায় সাফল্যের পুষ্প পল্লবে ভরে দিতে, চায় পূর্ণ কলেবরে বিকশিত করতে । সেক্ষেত্রে লক্ষ্য হচ্ছে মানব জীবনের সাফল্যের সোপান। লক্ষ্যহীন জীবন কান্ডারীবিহীন তারনীর ন্যায়। তাই জীবনের সফলতা লাভে এক স্থির লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হয়।
জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে শৈশবের ভাবনাঃ পৃথিবীর সকলে একই নিয়মে মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে এবং বিভিন্ন পারিপাশির্^ক পরিবেমে বেড়ে উঠে। শিশুকালে মানুষের মনে নানান রকম চিন্তা ভাবনা দোলা দেয়। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি শিশু যখন ভাবে তখন তার মনে বহু রকমের ইচ্ছা বাসা বাধেঁ। তেমনি আমিও শৈশবে অনেক ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম। ঐ সময় কেউ আমার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, ছোট্ট মন না বুঝে কত কিছুই যে হতে চাইত। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী এবং মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। কখনো বাবার মতো ব্যবসায়ী হয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চাইতাম, আবার কখনো মায়ের মতো শিক্ষক হয়ে ছাত্রদের বেত দিয়ে পিটাতাম। একটু বড় হয়ে পৃথিবীর অনেক কিছু জানার পর মনের ইচ্ছাও পাল্টে যায়। তখন ভাবতাম বড় হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বিখ্যাত কবি বা সাহিত্যিক হব, কখনো ভাবতাম বড় ডাক্তার হব, প্রকৌশলী হব, পাইলট হব, বৈজ্ঞানিক হব, এ ছাড়াও আরো কত কী। এরপর যখন পারিপার্শি^ক অব¯থা বুঝতে শিখলাম তখন মনে হলো আমি যা হতে চাই তাতে দেশের আপামর জনসাধারণের কতটুকুই বা লাভ। বড়লোক বা ভাগ্যবান বলে তারা আমার দিকে বিস্ময়ে তাকাবে কিন্তু আমাকে তো আপন কনে নিতে পারবে না। লক্ষ্য নির্বাচনের উপযুক্ত সময়ঃ প্রত্যেক মানুষ আগে কিংবা পরে তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। কিন্তু ছাত্রজীবনই ভবিষ্যৎ জীবনের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। এ সময় মানুষ যে বীজ বপন করে তাই অদূর ভবিষ্যতে ফুলে ফলে বিকশিত হয়ে উঠে। তবে কেবল স্বপ্ন ও কল্পনা দিয়ে লক্ষ্য স্থির করলেই হয় না- নিষ্ঠা , শ্রম, সাধনা, অধ্যবসায়, একাগ্রতা দিয়ে হয়েছে এবং সে অনুযায়ী আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধরণ করতে হবে। অনেকের কাছেই হয়তো গ্রহণযোগ্য হবে না। এ লক্ষ্যে বিপুল সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত নয়। আমার এ লক্ষ্য হচ্ছে একজন শিক্ষক হওয়ার বাসনা মাত্র। তাও কোনো এক মাধ্যমিক স্কুলে। আমার এ বাসনা সকলের কাছে না হলেও অন্তত গুণীজনের কাছে সাধূবাদ পাবে। আমি মেন করি, যে কাজ শুধু নিজের কাজে লাগে, সেটা জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না।
অভিভাবকগণের মতামতঃ আমার জীবনের লক্ষ্য নির্বাচনের আমার অভিভাবকদের অনেকেই বিস্মিত। এমনকি আমার শিক্ষকমন্ডলীও । বর্তমান প্রতিযোগিতার যুগে আমার এ লক্ষ্যকে মেনে নেয়া তাদের জন্য কষ্টকর বটে। কারণ, আমার পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজন চেয়েছিল আমি জীবনে বেশি অর্থ উপার্জন করব বড়লোক হব। তাই তাদের ইচ্ছা আমি আমার ছিল। প্রথমে আমার পিতামাতা ব্যাপারটিকে পাগলামি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পারবর্তিতে আমার দৃঢ়চেতা মনোভাব ও একাগ্রতা দেখে তারা আমাকে উৎসাহিত করছে। একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার জন্য তারা আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করছে। শুধু আমার পিতামাতাই নয়, আমার শিক্ষকমন্ডলী, ব›ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন আমার লক্ষ্যকে প্রথমে অবহেলা করলেও তারাই এখন আমাকে এ সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছে।
লক্ষ্য নির্বাচনের কারণঃ আমাদের চারপাশের জনগণ নানা দুঃখ দুর্দশায় জর্জরিত। রোগ, শোক, অভাব অনটন তাদের নিত্য সঙ্গী। উন্নত জীবনের আশা জীবনের আশা তারা করতে পারে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের কোনো ফরিয়াদ নেই, নেই কোনো প্রতিবাদ। যেকোনো অবস্থাতেই তারা নিশ্চল, নিশ্চুপ । শুধু শিক্ষার অভাবেই তাদের এ অবস্থা। শিক্ষার অভাবে তারা সুন্দর , নির্মল ও সৎ জীবনের সন্ধান পায়নি। তাই এ অজ্ঞ সমাজের প্রতি লক্ষ্য করে স্থির করেছি, আমি একজন শিক্ষক হব। কারণ শিক্ষকই এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে। শিক্ষক হয়ে এ দেশের অবহেলিত সমাজকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে রক্ষা করব, তাদের মাঝে জ¦ালিয়ে দেব শিক্ষার আলো। তারা খুঁজে পাবে উন্নত জীবনের সন্ধান।
পাঠ্যক্রম নির্বাচনঃ শিক্ষানীতি অনুসারে নবম শ্রেণিতে পাঠ্যক্রম নির্বাচনের সুযোগ পাওয়া যায়। শিক্ষকতাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আমি মানবিক শাখাকে বিশেষভাবে বেছে নিয়েছি। আমার ধারণা, বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষকে কিছুটা যান্ত্রিক ও তথ্যবহুল করে তোলে। আবার ব্যবসায় শিক্ষা মানুষের মানসিকতাকে অর্থমুখী করে তোলে। অন্যদিকে মানবিক শিক্ষা মানুষের মনকে দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন করে গড়ে তোলে, যা একজন শিক্ষকের প্রধান গুণ বলে আমি মনে করি। আর এ কারণেই আমি মানবিক শাখাকে বেছে নিয়েছি।
লক্ষ্য অর্জনের প্রস্তুতিঃ জীবনের যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করতে হলে একটা কর্মপন্থা নিয়ে কাজ করতে হয়। শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্যকে সফল করতে হলে আমাকেও একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি এখন দশম শ্রেণির ছাত্র। আগামী বছর এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করব এবং জিপিএ ৫ পাওয়ার চেষ্টা করব। তারপর ঢাকার যে কোন একটি স্বনামধন্য কলেজে ভর্তি হব। সেখানে থেকে জিপিএ ৫ নিয়ে এইচ.এস.সি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেব। তারপর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিষয়ে ভর্তি হব। অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে আমাদের গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে যোগদান করব। আমি জানি শিক্ষকতা একটি সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ পেশা। তাই আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি এলাকার দরিদ্র ও অসহায় শিশুদের লেখাপড়া করার সুযোগ সৃষ্টি করব। অনেক সময় দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে বহু শিশু ঝরে যায়। আমি এসব ঝরে পড়া শিশুদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করব। তা ছাড়া, গ্রামের বয়স্কদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তাও আমার রয়েছে।
সাফল্য লাভঃ আমার একক জীবনের সামান্য প্রচেষ্টায় হয়ত আমি বিরাট সাফল্য নিজের চোখে দেখতে পাব না। কিন্তু আমি যদি আমার শিক্ষার্থীদেরকে আমার ব্রতে দীক্ষিত করে যেতে পারি তবেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। যে দিন আমার শিক্ষা ও অনুপ্রেরণায় এ অজ্ঞ সমাজ থেকে শত শত বৈজ্ঞানিক , সাহিত্যক রাজনীতিবিদ বেরিয়ে এসে এদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে সেদিন আমার জীবনে আসবে চরম সার্থকতা।
উপসংহারঃ উচ্চকাক্সক্ষা পরিহার করে শিক্ষকতাকে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচনে করেছি। কেননা শিক্ষকতার মাধ্যমেই জাতীয় অগ্রগতি ও কল্যাণ সম্ভব। শিক্ষক হলো সমাজের স্বীকৃত বিবেক। যদি কোনো জাতি এ সম্প্রদায়ের মর্যাদার দানে অপারগ হয়, তবে একদিন না একদিন তাকে এ ভুলের মাশুল দিতেই হবে।
Share This Post