জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা-রচনা
জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা অথবা, জাতি ও নারী সমাজ
ভূমিকাঃ‘স্বর্ণ রৌপ্য অলংকারে যক্ষপুরীতে নারী করিল তোমায় বন্দিনী বলো কোন সে অত্যাচারী?”
নারীর প্রতি অবহেলা দেখে কবির সেই আক্ষেপ করার দিন এখন ফুরিয়ে এসেছে। শ্ক্ষিা দীক্ষা, জ্ঞান পরিমায় আজ নারীসমাজ পুরুষের পাশাপাশি সমান যেগ্যতায় অগ্রসর হয়ে চলেছে। সে দিনের সেই অভশপ্ত নারী ধর্মের গন্ডি থেকে বের হয়ে আজ নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চায় তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ষোলো আনা বজায় রেখে। শিক্ষার বিপুল ভোজে পুরুষের সাথে নারীরও পঙক্তিভোজের অধিকার রয়েছে। নারী আজ জয়যাত্রার পথে পা বাড়িয়েছে। অতীত ও বর্তমান নারী সমাজ: ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালি নারীসমাজ ছিল অবহেলিত , লাঞ্ছিত ও অধিকারহীন। সমাজ ব্যবস্তায় প্রতিটি স্তরে নারী ছিল খুবই পশ্চাৎপদ। পর্দাপ্রথার কঠিন বেড়াজালে তারা ছিল অবরুদ্ধ। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের মানবিক আক্ক্সাক্ষাগুলো তখন ছিল পদদলিত। “নারী শুধু স্বামীর সংসার দেখাশোনার জন্য ” এরূপ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার শিকার হয়ে তারা শিক্ষায় দীক্ষায়, অভিজ্ঞতায় এবং মননের উৎকর্ষতার বহু পিছিয়ে পড়ে। বর্তমানে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা অবস্থান ও মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্বতন সাধিত হয়েছে। নিজেদেরকে ঘরের চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ না রেখে তারা আজ দেশ ও জাতির উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। দেশের উন্নয়ন কাজের সকল স্তরে তাদের অবাধ বিচরণ লক্ষণীয়। দীর্ঘ দিনের দাসী মনোভাব পরিহার করে তারা যেন আজ জেগে উঠেছে। এ জন্য নারী বন্দরা করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন -
‘ এ বিশ্বে যত ফুটিয়েছে ফুল , ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাতে রূপ-রস-মধু-গন্ধ-সুনির্মল”।
সম্ভাবনাময় নারী: যে কোনো দেশ তথা জাতির উন্নয়নে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা একটি দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী । জনসংখ্যার এই বিরাট অংশ যদি পুরুষের পাশাপাশি দেশ তথা জাতির গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করে তাহলে পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে নারী সমাজের মধ্যেই পেয়ে যাব সচেতন শিক্ষিত মা কবিম সাহিত্যিক বিজ্ঞানী কিংবা সমাজ সেবিকা। তখনই দেশ পৌছে যাবে উন্নতি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে। আর আমরা শিক্ষিত ও সচেতন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হব।
জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকাঃ একটি দেশ শিক্ষায় যত এগিয়ে সে দেশ তত উন্নত ও সমৃদ্ধ । পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই তারা তাদের দেশের সকল ক্ষেত্রে নারী সমাজকে প্রধান্য দিয়েছে। দেশের উন্নয়মূলক সকল কাজে নারী সামাজের স্বতঃস্ফুর্ত পদচাণার বলেই তারা আজ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠিত। বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্ঠায় আমাদের দেশে নারীসমাজের চিত্র কিছুটা পরিবর্তন হল্যেও এ পরিবর্তনের ধারাবহিকতা ত্বরান্বিত করেই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে নারীসমাজকে উদ্বদ্ধ করতে হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী সমাজ: আবহমানকাল ধরে নারীরা পুরুসশাসিত সমাজে অবহেলিত হয়ে শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়লেও বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের প্রায় সম উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। জাতীয় উন্নয়নে যারা নিজেদেরকে যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছে ্ পুরুষের সমকক্ষতা লাভের আশায় এবং সর্বক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতেতারা যেন পণ করেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রের প্রতিটি স্থরে তারা ছেলেদের পাশাপাশি অবস্থান করছে। সাহিত্য ও গবেষণা কর্মেও নারীদের অবদান প্রশংসনীয়। তাই সহযোগীতার মনোভাব নিয়ে নারী সমাজকে যদি প্রকৃত শিক্ষায় মাধ্যমে দক্ষ ও কর্মনিষ্ঠ করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে তারা জাতি গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রা খতে সক্ষম হবে।
সন্তানের চরিত্র গঠনে নারী সমাজ: শিশুরা জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। আর শিশুকে সঠিকভবে গড়ে তোলার ব্যাপারে পিতার চেয়ে মা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করে থাকে। একটি শিশু যখন জন্মায় তখন সে নিতান্তই এক ইন্দ্রিয়সর্বস্ত প্রাণী। ইন্দ্রিয় দ্বারা সে তাড়িত হয়। শিশুর এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মা তার কোমল মনকে পথে চালত করতে সাহায্য করে। সামাজিক আচার-আচরণ শিখিয়ে মা তার সন্তানকে সমাজের একজন যোগ্য ও মর্যাদাবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। অর্থাৎ মা-ই সমৃদ্ধ জাতি গছনের সুদক্ষ কারিগর । তাই নেপোলিয়ন বলেছেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।” অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীসমাজ: অর্থনৈতিকভবে বাংলাদেশকে শক্তিশালী করতে বর্তমান পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সকল অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করছে। জাতীয় জীবনে উন্নতি সাধনে সকল কর্মক্ষেত্রে নারীসমাজকে দায়িত্ব বহন কাতে দেখা যাচ্ছে। তাদের ভুমিকার ক্ষেত্রও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘরে ও বাইরে তারা আজ কর্মমুখর জীবনের স্বাদ আস্বাদর করছে। অফিস আদালত থেকে শুরু করে ইট ভাঙার কাজেও পুরুষের পাশাপাশি নরীদের সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায়। তাদের জ্ঞান-বৃদ্ধি-মনীষা ও কর্মসিক্ত জীবনের চক্রে আবর্তিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার কথা স্মরণ করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী -অর্ধেক তার নর।”
সমারিক ক্ষেত্রে নারী: একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দেশের অভ্যন্তরের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যে ক্ষেত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে তা হচ্ছে সে দেশের সমরিক ক্ষেত্র। বর্তমানে আমাদের দেশের সামরিক ক্ষেত্রেও নারী সমাজ সদর্পে পদচাণা করছে। দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব নিয়ে তারা আজ দেশের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করছে। অভ্যন্তরীণ র্শঙ্খলা বহিনীর সদস্য হয়ে তারাও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। আমাদের দেশের সামরিক বাহিনীর নারী সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশরে অংশগ্রহণ করে শান্তিরক্ষায় অনন্য পরিচয় দিচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারী: বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও নারীরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছে। আমাদের দেশের প্রধানশন্ত্রি, স্পিকার ও বিরোধী দলের প্রধানও একজন নারী। তা ছাড়াও রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমানে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের সহযোগিতায় দেশ , জাতি ও সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে অধিকার আদায় তারা রাজপথে নেমে আন্দোলন করছে।
ইতিহাসের নারী অবদানে দৃষ্টান্ত: ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একুশের ভাষা আন্দোলনে মিছিলে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে , ‘৬২, ৬৬, ৬৯ এর মিছিলে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। তা জন্যই আমরা সহজে স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তা ছাড়া ৯০ এর গণআন্দোলনেও নারীরা স্মরণীয় অবদান রেখেছিল। দেশ তথা জাতির কল্যাণে নারী সমাজকে এগেয়ে আনতে আদর্শব্রতী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শামসুন্নাহার সুফিয়া কামালের মতো মহীয়সী নারীরা চিরস্মরনীয় অবদান রেখে গেছেন। এ ছাড়া প্রীতি লতা ওয়অদ্দেদার মাদার তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদাশকুরী প্রভৃতি মহীয়সী নারী দেশের সেবাই মাধ্যমে দেম তথা জাতি গচনে অবিস্মণীয় নজির স্থাপন করে গেছেন। সর্বক্ষেত্রে নারীর সম্পৃক্ততা :জাতীয় জীবনে নারীজাতিকে উকেক্ষা করে উন্নয়ন সাধিত হতে পারে না। তাই বর্তমানে নারী শিক্ষার উন্নয়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। ফলে নারী আজ শিক্ষায় সরস্বতীম, গৃস্থলীতে দ্রৌপদ,ি আর্তর সেবায় সুভদ্র্য বীরত্বে দুর্গা এবং সাহসে শৌর্যে রিজিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কল্যাণময়ী, স্নেহময়ী এবং শান্তির পবিত্র আধার। ঘরে ঘরে আজ নিচ্ছে আদর্শব্রতী বেগম রোকেয়া , শামসুন্নহার মাহমুদ, সুফিয়া কামালের মতো মহীয়সী নারী এবং একই সাথে তারাঁ বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং সমাজের সর্ববিষয়ে অনুশাসন পালন করে চলছেন। আজ জীবনের সকল কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সাথে নারীকে কাজ করতে দেখে মনে হয়, নজরুল সার্থক, সেই আদর্শব্রতী রমনী বেগম রোকেয়া সার্থক। জাতীয় জীবনের উন্নয়নে তাঁদের অবদান আজ সত্যিই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার: একটি আদর্শ জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা জাতি গঠনে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। অনেকক্ষেত্রে তারা পুরুষতান্ত্রিক মন মানসিকতা ও ধর্মীয় গোড়ামির শিকার। তাদের এ অবস্থা থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীরা যদি পুরুষের সাথে কাধেঁ কাধ মিলিয়ে কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে পদচরণা করে তবেই দেশ তথা জাতির উন্নতি সম্ভব হবে।
Share This Post