তৎপুরুষ সমাস - বিস্তারিত আলোচনা (বাংলা ব্যাকরণ)
তৎপুরুষ সমাস - বিস্তারিত আলোচনা
পূর্বপদের বিভক্তি লোপ হয়ে সে সমাস হয় এবং যাতে পরপদের অর্থই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন- বিপদকে আপন্ন = বিপদাপন্নদুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত
গাছে পাকা = গাছপাকা ইত্যাদি।
তৎপুরুষ সমাসে প্রকারভেদ
তৎপুরুষ সমাস নয় প্রকার। যথা-
১. দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাসঃ পূর্বপদে দ্বিতীয়া বিভক্তির (কে, রে) লোপ হয়ে যে সমাস হয়, তাকে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন- কলাকে বেচা = কলাবেচা,
রথাকে দেখা = রথদেখা।
ব্যাপ্তি অর্থেও দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন-
চিরকাল ব্যপিয়া সুখ = চিরসুখ। এরূপ গা-ঢাকা , রথদেখা, বীজবোনা, ভাতরাঁধা, ছেলে-ভুলানো, নভেল-পড় ইত্যাদি।
২. তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাসঃ পূর্বপদে তৃতীয়া বিভক্তির (দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক) লোপ হয়ে সে সমাস হয়, তাকে তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে।
যেমন- মন দিয়ে গড়া = মনগড়া,
শ্রম দ্বারা লব্ধ = শ্রমলব্ধ,
পাঁচ দ্বারা কম = পাচঁকম ইত্যাদি।
ঊন, হীন, শূন্য প্রভৃতি শব্দ উত্তরপদ হলেও তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয় । যথা-
এক দ্বারা ঊন = একোন;
বিদ্যা দ্বারা হীন = বিদ্যাহীন;
জ্ঞান দ্বারা বা জ্ঞানের শূন্য = জ্ঞানশূন্য;
পাঁচ দ্বারা কম = পাচঁ কম (একশ)
ক. উপকরণবাচক বিশেষ্য পদ পূর্বপদে বসলেও তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়।
যেমন- স্বর্ণ দ্বারা মন্ডিতহ = স্বর্ণমন্ডিত। এরূপ-হীরকখর্চিত, রত্নশোভিত ইত্যাদি।
খ. পূর্বপদের তৃতীয়া বিভক্তির লোপ না হলে অলূক তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন-
তেলে ভাজা = তেলেভাজা, কলে ছাঁটা = কলেছাঁটা। এরূপ তাঁতেবোনা, মায়েখোদনো, পোকায়কাটা, হাতেকাটা ইত্যাদি।
৩. চতুর্থী তৎপুরুষ সমাসঃ পূর্বপদে চতুর্থী বিভক্তি (কে, এর জন্য, এর নিমিত্ত, এ তরে) লোপ হয় যে সমাস হয়, তাকে চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন-
গুরুকে ভক্তি = গুরুভক্তি
আরামের জন্য কেদারা = আরামকেদারা,
বিয়ের জন্য পাগল = বিয়েপাগল,
বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় = বালিকা বিদ্যালয়,
বসতের নিমিত্ত বাড়ি = বসতবাড়ি।
এরূফ ছাত্রাবাস, ডাকমাশুল, চোষকাগজ, শিশুমঙ্গল, মুসাফিরখানা, হজযাত্রা, মালগুদাম, রান্নাঘর, মাপকাঠি, মেয়েস্কুল, পাগলাগারদ ইত্যাদি।
৪. পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাসঃ পূর্বপদে পঞ্চমী বিভক্তি (হতে , থেকে) লোপ হয়ে যে সমাস হয়, তাকে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস বলে।
যেমন- বিলাত থেকে ফেরত = বিলাত ফেরত,
ঋণ হতে মুক্ত = ঋণমুক্ত,
বোঁটা থেকে খসা = বোঁটাখসা।
সাধারণথ চ্যুত, জাত, আগত, ভীত, গৃহীত, বিরত, মুক্ত, উর্ত্তীণ, পালানো, ভ্রষ্ট ইত্যাদি পরপদের সঙ্গে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন-
স্কুল থেকে পালানে = স্কুলপালানো,
জেল থেকে মুক্ত = জেলমুক্ত ইত্যাদি।
কোনো কোনো সময় পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাসের ব্যাসবাক্যে এর ,চেয়ে ইত্যদি অনুসর্গের ব্যবহার হয়। যেমন-
পরাণের চেয়ে প্রিয় = পরাণপ্রিয়।
৫. ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসঃ পূর্বপদে ষষ্ঠী বিভক্তি (র,এর) লোপ হয়ে যে সমাস হয়, তাকে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস বলে।
যেমন-
রান্নার ঘর = রান্নাঘর,
চায়ের বাগান = চা-বাগান,
খেয়ার ঘাট = খেয়াঘাট।
এরূপ ছাত্রসমাজ, দেশসেবা, দিল্লীশ্বর, বাঁদরনাচ, পাটক্ষেত ছবিঘর, ঘোড়দৌড়, শ্বশুরবাড়ি, বিড়ালছানা ইত্যাদি।
ক. ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসে ‘রাজা’ স্থলে ‘রাজ’, পিতা , মাতা, ভ্রাতা স্থলে যথাক্রমে ‘পিতৃ’ , ‘ভ্রাতৃ’, হয়। যেমন-
গজনীয় রাজা = গজীনরাজ,
রাজার পুত্র = রাজপুত্র
পিতার ধন = পিতৃধন,
মাতার সেবা = মাতৃসেবা,
ভ্রাতার স্নেহ = ভ্রাতৃস্নেহ
খ. পরপদে সহ, তুল্য নিভ, প্রায়, সহ, প্রতিয়-এসব শব্দ থাকলেও ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। যেমন-
পত্নীর সহ = পত্নীসহ,
কন্যার সহ = কন্যাসহ,
সহোদরের প্রতিম = সহোদরপ্রতিম/সোদরপ্রতিম ইত্যাদি।
গ. কালের কোনো অংশবোধক শব্দ করে থাকলে তা পূর্বে বসে। যথা-
অহ্নের (দিনের) পূর্বভাগ = পূর্বহ্ন
ঘ. পরপদে রাজি, গ্রাম, বৃন্দ, গণ, র্যূথ প্রভৃতি সমষ্টিবাচক শব্দ থাকলে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস হয়। যথা-
ছাত্রের বৃন্দ = ছাত্রবৃন্দ, গুণের গ্রাম = গুণগ্রাম, হস্তীর যূথ = হস্তীযূথ ইত্যাদি।
ঙ. অর্ধ শব্দ পরপদ হলে সমস্তপদে তা পূর্বপদ হয়। যেমন- পথের অর্ধ = অর্ধপথ।
চ. শিশু, দুগ্ধ ইত্যাদি শব্দ পরে থাকলে সমস্তপদে তা আগে আসে। যেমন- মৃগীর শিশু = মৃগশিশু ছাগীর দুগ্ধ = ছাগদুগ্ধ ইত্যাদি।
ছ. ব্যাসবাক্যে ‘রাজা’ শব্দ পরে থাকলে সমস্তপদে তা আগে আসে। যেমন-
পথের রাজা = রাজপথ,
হাঁসের রাজা = রাজহাঁস।
অলূক ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাসঃ ঘোড়ার ডিম, মাটির মানুষ, হাতের পাঁচ, মামার বাড়ি. সাপের পা, মনের মানুষ, কলের গান ইত্যাদি। কিন্তু ভ্রাতার পুত্র = ভ্রাতুষ্পুত্র (নিপাতনে সিদ্ধ)।
৬. সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসঃ পূর্বপদে সপ্তমী বিভক্তি (তে, এ, য়) লোপ হয়ে যে সমাস হয়, তাকে সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন-
গাছে পাকা = গাছপাকা
রাতে কানা = রাতকানা
অকালে মৃত্যু = অকালমৃত্যু
এরূপ দিবানিদ্রা, বাকপটু, গোলাভরা, তালকানা, বিশ্ববিখ্যাত, ভোজনপটু, দানবীর, বাক্সবন্ধি, বস্তাপচা, মনপরা, ইত্যাদি।
সপ্তমী তৎপুরুষ সমাসে কোনো কোনো সময় ব্যাসবাক্যে পরপদ সমস্ত পদের পূর্বে আসে। যেমন-
পূর্বে ভূত = ভূতপূর্ব, পূর্বে অশ্রুত = অশ্রুতপূর্ব, পূর্বে অদৃষ্ট = অদৃষ্টপূর্ব ইত্যাদি।
৭. নঞ্ তৎপুরুষ সমাসঃ না-বাচক নঞ্ অব্যয় ( ন, নেই/নাই, নয় ) পূর্বে বসে যে তৎপুরুষ সমাস হয়, তাকে নঞ্ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন-
ন ভাব = অভাব
ন সুখ = অসুখ
ন কাল = আকাল
এরূপ অনাচার, অকাতর, অনাদর, নাতিদীর্ঘ, নাতিখর্ব, বেতাল, আধোয়া, নামঞ্জুর, অকেজো, অজানা, অচেনা, আলুনি, নাছোড়, অনাবাদী, নাবালক, অব্শ্বিাস, অলৌকিক, অকেশা, অসুর, অকাল, অঘাট, অমানুষ, অসঙ্গত, অভদ্র, অনন্য, অগম্য ইত্যাদি।
৮. উপপদ তৎপুরুষ সমাসঃ কৃদন্ত পদের সঙ্গে উপপদের যে সমাস হয়, তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে।
যেমন- জলে চরে যা = জলচর
জল দেয় যে = জলদ
ধামা ধরে যে = ধামাধরা
ছেলে ধরে যে = ছেলেধরা
পকেট মারে যে = পকেটমার
পঙ্কে জন্মে যা = পঙ্কাজ এরূপ গৃহস্থ, সত্যবাদী, ইন্দ্রজিং, হাড়ভাঙ্গা, মাছিমারা, ছারপোকা, ঘরপোড়া, র্বণচোরা, গলাকাটা, পা-চাটা, পাড়াবেড়ানি, ছা-পোষা ইত্যাদি।
৯. অলুক তৎপুরুষ সমাসঃ যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের দ্বিতীয়া বিভক্তি লোপ হয় না, তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন- গায়ে পড় = গায়েপড়া, ঘিরে ভাজা = ঘিয়েভাজা, কলের গান = কলের গান, গরুর গাড়ি = গরুর গাড়ি ইত্যাদি
Share This Post