বাংলা ভাষা ও পরিচয় (গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা)


বাংলা ভাষা ও পরিচয়


ভাষা মানুষ তার মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কন্ঠধ্বনি এবং হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে। কন্ঠধ্বনির সাহায়তায় মানুষ মনের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম ভাবও প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। কন্ঠধ্বনি উপাদান। এই ধ্বনির সাহায্যে ভাষার সৃষ্টি হয়। আবার ধ্বনির সৃষ্টি হয় গলনালি, মুখবিবর, কন্ঠ, জিহ্বা, তালু, দাঁত, নাক, ইত্যাদি। বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে। বাগ্যন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে। সকল মানুষের ভাষাই বাগ্যন্ত্রে দ্বারা সৃষ্টি। তুবও একই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির অর্থ বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এ কারণে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কন্ঠনিঃসৃত বাক্ সংকেতের সংগঠনকে ভাষা বলা হয়। অর্থাৎ বাগ্যন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট অর্থবোধক ধ্বনির সংকেতের সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হলো ভাষা।

ভাষার সংজ্ঞাঃ  ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ‘‘ মনুষ্য জাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনি সকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তার নাম ভাষা।”

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি দ্বারা নিষ্পন্ন কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত , ম্বতন্ত্রভাবে অবহিত তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।”

শহিদ মুনীর চৌধুরীর মতে, “ মনোভাব প্রকাশের জন্য মানুষের ফুসফুস তাড়িত বায়ু গলানালী, মুখবিবর, কন্ঠ, জিহ্বা, তালু, দাঁত, ওষ্ঠ, নাক প্রভৃতি বাগ্যন্ত্রের সহায়তায় ও মাধ্যমে বেরিয়ে আসার সময় যে আওয়াজ বা ধ্বনি সৃষ্টি হয়, তার নাম ভাষা।”

সুতরাং বলা যায়, মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে যে সব সর্বজনস্বীকৃত ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে, তাকে ভাষা বলে।

ভাষার পরিবর্তন দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান করে মানুষ আপন মনোভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বস্তু ও ভাবের জন্য বিভিন্ন ধ্বনির সাহায্যে শব্দের সৃষ্টি করেছে। সেসব শব্দ মূলত নির্দিষ্ট পরিবেশে মানুষের বস্তু ও ভাবের প্রতীক মাত্র। এ জন্যই আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। সে ভাষাও আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়ে এসেছে। ফলে, এ শতকে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে ভাষা ব্যবহর করে, হাজার বছর আগেকার মানুষের ভাষা ঠিক এমনটি ছিল না।

বাংলাভাষার বর্তমান অবস্থানঃ  বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের বের্শি ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বাংলা একটি ভাষা। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলাদেশের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ এবং ত্রিপুর া, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের ভাষা বাংলা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসবহ বিশে^র অনেক দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা।

বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশঃ  অন্য সব কিছুর মতো ভাষাও জন্ম নেয়, সময়ে সময়ে রুপ বদলায়। আজ আমরা যে ভাষায় কথা বলি, কবিতা লিখি, গান গাই শুরুতে এ ভাষায় রুপ এ রকম ছিল না। হাজার বছর ধরে ক্রমবির্বতনের ফলে বাংলা ভাষা বর্তমান রুপ লাভ করেছে। দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটেছে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বের ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা থেকে ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব । আমাদের বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার একটি শাখা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে। বাংলা আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক। এ ভাষা আর্যদের আগমনের পর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। আর্যদের ভাষার নাম প্রাচীন বৈদিক ভাষা। পরবর্তীতে এ ভাষায় ব্যাপক সাধন হয়। এভাবে পন্ডিতগণ বৈদিক ভাষাকে একটি সাহিত্যের ভাষায় রুপ দেন। পুরোনো ভাষাকে সংস্কার করা হয়েছিল বলে এ ভাষার নাম হয় সংস্কৃত ভাষা। অনেকে বলেন, সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আধুনিক পন্ডিতগন তা মেনে নেননি। কারণ প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ ছাড়া সাধারণ মানুষ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলত না। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার নাম ‘প্রকৃত ভাষা’। সময়ের সাথে সাথে ভাষায়ও আসতে থাকে পরিবর্তন। বইপত্র লেখার মাধ্যমে ভাষা উৎকৃর্ষ লাভ করে। প্রাকৃত ভাষা থেকে সৃষ্টি হয় দুটি ভাষা-পালি এবং অপভ্রংশ। তবে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ‘প্রাকৃত ভাষা’ নামেই রয়ে যায়। এ সময় পূর্ব ভারতের অনেক দেশে নতুন নতুন ভাষার সৃষ্টি হতে থাকে। এগুলোর সৃষ্টি হয় অপভ্রংশ ভাষা থেকে। এক সময় এভাবেই সৃষ্টি হয় আমাদের বাংলা ভাষা।

কেউ কেউ মনে করেন, বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে। আবার অনেকে মনে করেন ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল। জন্মের পর থেকে বাংলা ভাষা কোনো এক স্থানে পাথরে মতো নিশ্চল হয়ে বসে থাকেনি। এর ধারাবাহিক পরিবর্তন হয়েছে মানুষের কন্ঠে, কবির কবিতায় ও গল্পে, শিল্পীর গানে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। আদি থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়ের বাংলা ভাষাে ক প্রধানত তিন যুগে ভাগ করা হয়। যেমন : ১. প্রাচীন যুগ, ২. মধ্যযুগ ও ৩. আধুনিক যুগ।
বাংলা ভাষার কালক্রম ও নিদর্শনঃ 
১। প্রাচীন যুগঃ  ৬৫০ বা ৯৫০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত। এ যুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো ‘চর্যাপদ’।

২। মধ্যযুগঃ  ১২০১ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত। এই যুগের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো বডুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ; মালাধন বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় ; কৃত্তিবাসের রামায়ন ; বিপ্রদাস পিপলাই এর মনসাবিজয় ; মানিক দাত্তের চন্ডীমঙ্গল ; শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা ; দৌলত উজির বাহরাম কানের লাইলী মজনু ; আলাওলের পদ্মাবতী ; কাশীরাম দাসের মহাভারত ইত্যাদি। ৩।

আধুনিক যুগঃ  ১৮০১ সাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের সূত্রপাত ঘটে। এই গদ্যকে সমৃদ্ধ করতে রাজা রামমোহন নায় ও ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান অবিস্মরনীয়। তারপর মাইকেল মধুসুদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ সাহিত্যিক দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে। বিশ^কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সাৈ গীতাঞ্জলি কাব্য গ্রন্থ রচনা করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এবং বাংলা ভাষার সুনাম বয়ে আনেন।

বাংলা ভাষার বিভিন্ন রূপঃ  কথ্য, চলিত ও সাধু রীতি বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের জনগণ নিজ নিজ অঞ্চলের যে ভাষায় কথা বলে এগুলোকে আঞ্চলিক, কথ্য বা উপভাষা বলে। পৃথিবীর সব ভাষারই উপভাষা রয়েছে। এক অঞ্চলের জনগণের মুখের ভাষার সঙ্গে অপর অঞ্চলের জনগণের মুুখের ভাষার যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। ফলে, এক অঞ্চলের ভাষা অন্য অঞ্চলের লোকের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণের কথ্য ভাষা দিনাজপুর বা রংপুরের লোকের পক্ষে খুব সহজবোধ্য হয়। এ ধরণের আঞ্চলিক ভাষাকে বলার ও লেখার বাষা হিসেবে সর্বজনীন স্বাকৃত দেওয়া সুবিদাজনক নয়। কারণ, তাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাভাষীদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানে অন্তরায় দেখা দিতে পারে। সে কারণে, দেশের শিক্ষিত ও পন্ডিতসমাজ একটি আদর্শ ভাষা ব্যবহার করেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী শিক্ষিত জনগণ এ আদর্শ ভাষাতেই পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও ভাবের আদার-প্রদান করে থাকেন। বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষার কথ্য রীতি সমন্বয়ে শিষ্টজনের ব্যবহৃত এই ভাষাই আদর্শ চলিত ভাষা। বাংলা সাহিত্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হলেন প্রথম চৌধুরী।
বাংলা, ইংরেজী , আরবী, হিন্দি প্রভৃতি ভাষার মৌখিক বা কথ্য এবং লৈখিক বা লেখ্য এই রূপ দেখা যায়। ভাষার মৌখিক রুপের আবার রয়েছে একাধিক রীতি : একটি চলিত কথ্য রীতি, অপরটি আঞ্চলিক কথ্য রীতি। বাংলা ভাষার লৈখিক বা লেখ্য রূপেরও রয়েছেঠ দুটি রীতি। একটি চলিত রীতি, অপরটি সাধু রীতি।
বাংলা ব্যাকরণ ও এর আলোচ্য বিষয়
Previus
Conditional Sentence: Practice with answer
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম