বাংলা রচনাঃ বাংলাদেশের কুটির শিল্প
বাংলাদেশের কুটির শিল্প
ভূমিকাঃ কুটির শিল্প বাংলার গৌরব ও বাঙালির ঐতিহ্য । এক সময় বাংলাদেশ কুটির শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল, সমগ্র বিশ্বের এর সুনাম ও কদর ছিল। ঘর গৃহস্থালির প্রায় সবকিছুই তৈরী হতো এ দেশের গ্রামের ঘরে ঘরে । এসব কুটির শিল্পজাত দ্রব্যসামগ্রী শুধু দেশীয় প্রয়োজনই মিটাত না বরং বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশে রপ্তানি করে ও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। কুটির শিল্পঃ সাধারণত কুটির শিল্প বলতে স্বল্প পুঁজি বা মূলধণ খাঁটিয়ে স্বল্প সংখ্যক লোক ঘরে ঘরে বসে শারীরিক শ্রম ও মেধা খাটিয়ে যে সব দ্রব্য সামগ্রী তৈরী করে সেগুলো বোঝায়। আমাদের দেশের কামার,কুমার, তাঁতি, কাঁসারি, শাঁখারি, স্বর্ণকার, কাঠমিস্ত্রি প্রভৃতি শ্রেণীর লোকজন তাদের জীবন ও জীবিকা অর্জনের জন্য যে সব জিনিস উৎপাদন করে থাকে তাও কুটির শিল্পের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের কুটির শিল্পঃ কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয়তা নানা উপকরণ রয়েছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশের শিল্পখঅত অনেকাংশেই কুটির শিল্পের উপর নির্ভরশীল । তাতঁশিল্প, চামড়া শিল্প,মৃৎ শিল্প, ধাতু শিল্প, অলংকার শিল্প প্রভৃতি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের গড়া একটি সমৃদ্ধ জনপদ হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। এছাড়া রন্ধনশিল্প,সূতাশিল্প,চর্মশিল্প , রেশম শিল্প ইত্যাদি ও কুটির শিল্পের আওতাভুক্ত। কুটির শিল্পে নানা শ্রেণীর লোক কাজ করে থাকে। যেমন সূত্রধর, কর্মকার, কুমার,শাঁখারী ইত্যাদি।
কুটির শিল্পের বৈশিষ্টঃ কুটির শিল্পের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে। তার মধ্যে প্রদান হচ্ছে স্বল্প মূলধন। কুটির শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন খরচ কম বিধায় দাম ও কম। তবে কুটির শিল্পের নৈতিবাচক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কুটির শিল্প জাত দ্রব্য তেমন একটা চাকাচিক্যময় নয়: আর এদিক দিয়েই কুটির শিল্প যান্ত্রিক কাছে বাজার হারাচ্ছে। উল্লেখ করা যেত পারে, সমুদ্রয় কুটির শিল্পজাত দ্রব্যই যে চাকচিক্যহীন বা অনন্নুত এমন নয়,অনেক কুটির শিল্পজাত দ্রব্যই বিশ^জোড়া সুনাম অর্জন করতে সক্ষম । তবে বৃহদায়তন শিল্পের তুলনায় কুটির শিল্প যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে । কোনো কোনো ক্ষেত্রে কুটির শিল্প বৃহদায়তন শিল্পের পরিপূর্ণ হিসেবে ও কাজ করে। তাই অনেক অসুবিধায় পরে ও কুটির শিল্প প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত টিকে আছে।
কুটির শিল্পের অতীত গৌরবঃ বাংলাদেশের কুটির শিল্প একসময় সার বিশে^র খুব বিখ্যাত ছিল। ঢাকার মসলিন সূক্ষতা ও উৎকর্ষের জন্য বাংলাদেশের কুটির শিল্পের বেশ কদর ছিল। এদেশের কুটির শিল্পজাত দ্রব্য পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক রপ্তানি হতো। কেবল মসলিন কাপড় নয়, বাংলার মৃৎশিল্প, ছুরি ,কাঁচি ইত্যাদি শিল্পদ্রব্য ও বাংলাদেশের গর্ব ছিল। কুমিল্লার হুক্কা,ময়মনসিংহের ছিট কাপড়, আর সিলেটের শীতল পাটির সাথে কোনো কিছু তুলনা চলত না। এ কুটির শিল্পের বিভিন্ন শ্রেণীর কারুশিল্পের স্বাচ্ছন্দ্য ও সচ্ছলতা বজায় রাখতে সহায়ক ছিল।
কুটির শিল্পের অবনতির কারণঃ কুটির শিল্পের সেই গৌরবময় অবস্থান এখন আর নেই। এখন এ ঐতিহ্য মৃতপ্রায় । কারণ এ শিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার অনুপস্থিত । এর ফলে বৃহদায়তন শিল্পের তুলনায় এ শিল্পে ক্রমেই পছিয়ে পড়ছে। বিদেশি পণ্যের বাহারি সমাহারে আমাদের বাজার ছেয়ে আছে । তাই দেশীয় কুটির শিল্পজাত পণ্যসমূহ তার সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছে না । এ ছাড়া বর্তমানকালে মানুষের রুচির যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলে কুটির শিল্পজাত দ্রব্যগুলো প্রতি মানুষের আগ্রহ্য যথেষ্ট কমে গিয়েছে। দরিদ্রতার কারণে কুটির শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত কারিগরেরা ক্রমেই এ পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশার ঝঁকছে।ফলে কুটির শিল্প তার পুরানো জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। তা ছাড়া সরকারি পৃষ্টপোষতার অভাবে ও কুটির শিল্প ক্রমেই অবনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে মূলত বাংলার প্রাচীন কালের ঐতিহ্যময় কুটির শিল্প তার জৌলুস হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয়তাঃ কুটির শিল্প আমাদের গৌরব। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে এ শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য । হাতে তৈরী শিল্পজাত দ্রব্যাদি এক দিকে যেমন দেশবাসীর অনেক চাহিদা যোগান দিতে পারে, অন্যদিকে তেমনি বিদেশী দ্রব্য সম্ভরের আমদানির পরিমাণ হ্রাস করে দেশের বৈদেশিক ¤্রদ্রার রোধ করে দেশকে স্বনির্ভর করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। কুটির শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হলে বাংলাদেশের বেকার নারী ও পুরুষেরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্বি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
কুটির শিল্পকে পুনজীবিত করার উপায়ঃ বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের উন্নতি বিধানে কুটির শিল্পকে পুনজীবিত করা অর্বশক। এ শিল্পের উন্নতির জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সংশিষ্ট সকলকে সচেষ্ঠ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশী শিল্পদ্রব্যের মোহ ত্যাগ করে দেশীয় শিল্পদ্রব্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কুটির শিল্পের কারিগরদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্টানের সহায়তা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া দেশের অদক্ষ নারীসমাজকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ শিল্পের প্রতি আগ্রহী করার উদ্যোগ নিতে হবে। কুটির শিল্পজাত পণ্যের বিপণন ব্যবস্থার দিকে উৎপাদন শ্রেণীকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। সমবায় পদ্ধতিতে প্রচলন করে কুটির শিল্পের পণ্য উৎপাদন প্রতি কুটির শিল্পীদের উৎসাহ যোগাতে হবে। এ ছাড়া ও নতুন নতুন কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহন ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। কুটির শিল্পের বাজার দেশের মধ্যে সম্প্রসারিত করে দেশের বাইরে ও বাজারের প্রসার ঘটাতে হবে। আর এ সকল উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলেই দেশের কুটির শিল্প তার হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো কুটির শিল্প। কুটির শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা জাতীয় অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব। এখানে কুটির শিল্প বৃহদায়তন শিল্পের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। উন্নত দেশে বৃহদায়তন শিল্পের পাশাপাশি যদি কুটির শিল্পের অস্তিত্ব সগৌরবে থাকতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের ও তা সম্ভব । জাপানে মোট শ্রমশক্তি শতকারা ৩০ ভাগ ক্ষুদ্রায়তন শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে। আর জাপানে রপ্তানি আয়ের শতকার ৬০ ভাগ শিল্প থেকে আসে। তাই বাংলাদেশের কুটির শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভবনা যথেষ্ঠ উজ্জ্বল। সঠিকভাবে যদি এ শিল্পের প্রতি সচেতন ও যত্ন বান হওয়া যায়। তাহলে বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্পের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে প্রমাণিত হবে।
উপসংহারঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে সুদৃঢ করতে হলে আমাদের আজ কুটির শিল্পের উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে। তবে অত্যন্ত সুখের বিষয় এই যে আমাদের সরকার কুটির শিল্পের উন্নয়নের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছেন। আমরা আশাবাদী যে, কুটির শিল্পসমূহ তাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরায় ফিরে পাবে।
Previus
Next
Share This Post