রচনাঃ দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ


  দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ

 অথবা, বিদ্যুৎ ও আধুনিক জীবন

 অথবা, বিদ্যুৎ ও বর্তমান সভ্যতা

ভূমিকাঃ আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ । আর এ যুগের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের আবিষ্কার মানব সভ্যতার ইতিহাস সূচিত হয়েছে এক কালজয়ী অধ্যায়। এর অবদানে মানবজীবন ও সভ্যতার আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। এর ঐন্দ্রজালিক শক্তি গোটা বিশ্বকে এনে দিয়েছে মানুষের হাতের মুঠোয়, আধুনিক জীবনকে করেছে আরও আধুনিক। এর অভাব মানুষের কর্মচঞ্চল দিনকে করে দেয় স্থবির, প্রাত্যহিক জীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ।

বিদ্যুৎ আবিষ্কাররের পূর্বে পৃথিবীর অবস্থাঃ বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পূর্বে পৃথিবীর ছিল অন্ধকার ও তমসাচ্ছন্ন। মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং জীবনধারণের উপায় ও পদ্ধতি ছিল খুবই জটিল। নানা কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও বৈচিত্র্যময়। প্রকৃতি মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। তখন মানুষের কৃষি, যোগাযোগ এবঙ দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থা ছিল দুর্বিষহ। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পূর্বে পৃথিবীতে সভ্যতার লেশমাত্র ছিল না। তখন মানুষ ছিল প্রকৃতিন দাস। বিদ্যুতের আবিষ্কারঃ বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে ( ১৭৯১-১৮৬৭) বিদ্যুৎ শক্তি আবিষ্কার করেন। আর এ বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োগ কৌশল কার্যকর করেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। বর্তমান সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতি সাধনে ফ্যারাডে ও এডিসনের এ আবিষ্কার এ অনন্য অবদান।

বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পরবর্তী অবস্থাঃ বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের চমকে আধুনিক সভ্যতা বরাবরই উদ্ভাসিত হয়েছে। মানব-বুদ্ধি যে দিন প্রতিদিনের প্রয়োজনে আকাশের ক্ষণ বিদ্যুৎকে আবদ্ধ করল মর্ত্যসীমায়, সে দিনই শুরু হলো মানব সভ্যতার এক স্মরণীয় অধ্যায়ের জয়যাত্রা। সভ্যতার নবদিগন্তের উন্মোচন ঘটল। অবসান ঘটল বহু শতাব্দিয় জড়ত্বের। দিকে দিকে আলোর বন্যা বয়ে গেল। বিদ্যুতের জীয়নকাঠিন স্পর্শ পেয়ে বর্তমান যন্ত্রসভ্যতা হলো আরও বেগবান। দিগ¦জয়ের নেশায় মানুষ হলো দিশেহারা। গড়ে উঠল নগর-বন্দর, কল-কারখানা। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো হলো স্ফীত। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাকে বশে আনার সাথে সাথে কায়িক শ্রমের করা হয় বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি মানুষের সময়কে বাচিঁয়ে দিয়ে এবং দূরত¦ কমানো মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে সম্প্রীতিভাব বাড়িয়ে দিয়েছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রার বিদ্যুৎ

ক. গৃহস্থালি প্রয়োজনে বিদ্যুৎ/দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের গুরুত্বঃ বর্তমান সভ্যতার সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হলো বিদ্যুৎ। পৃথিবীকে সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করার জন্য মানুষ বিদ্যুৎকে বিভিন্নমুখী কাজে লাগাছে। বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন অর্থহীন। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার অরিসীম। এটি ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনাও করা যায় না। আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাত, যেমন-বৈদুতিক বাতি রাতে অন্ধকারকে আলোকিত করছে, তাপদগ্ধ নিদারুপ অস্বস্তির অবসান ঘটাতে ঘুরছে পাখা, চলছে এয়ারকুলার, বাসগৃহকে করছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রান্নাবান্নায়ও বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিদ্যুতের সাহায্য খাদ্য সংরক্ষণে রেফ্রিজারেটর, কাপড় ধোয়ায় ওয়াশিং মেশিন, রান্নায় ওভেন, পানি গরম করতে হিটারের ব্যবহার এখন খুবই জনপ্রিয় ও সুপরিচিত। বিদ্যুৎ বিনোদনের ক্ষেত্রে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। টেলিভিশন , ভিসিআর, ভিসিডি, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, কম্পিউটার, ভিডিও গেম ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত মানুষের প্রতিটি মুহুর্তের সর্বাধুনিক উদ্ভাবন ই-মেইল; যা মুহুর্তের মধ্যে পৃথিবীর অপর প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে। রোগ-ব্যাধি নিরাপত্তা কাজেও বিদ্যুৎ লাগিয়েছে তার নিরাময়কারী হাত।

খ. কৃষিতে বিদ্যুতের অবদানঃ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কৃষিকাজে বিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার এখনও সম্ভব হয়নি। তবে ইতোমধ্যে বিদ্যুতের প্রভাব আমাদের কৃষি ক্ষেত্রেও পড়েছে। সীমিত আকারে হলেও কোনো কোনো দিক দিয়ে বিদ্যুতের অবদানে দেশে কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে বিদ্যুতের সাহায্যে গভীর ও অগভীর নলকূপ চালিয়ে পানি সেচ দেওয়া হচ্ছে। শস্য মাড়াই এবং শস্য ভাঙানোর কাজ হচ্ছে বিদ্যুতের সাহায্যে চালিত কলের মাধ্যমে। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত উন্নতমানের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিদ্যুতে সহায়তা নেয়া হচ্ছে।

গ. কৃষিতে বিদ্যুতের অবদানঃ একটি দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য যে সকল শর্ত অপরিহার্য, শিল্পোন্নয়ন তার মধ্যে একটি। আর বিজ্ঞানের যে অসীম শক্তির বদৌলতে শিল্পকারখানার চাকা সচল রয়েছে, তা হচ্ছে বিদ্যুৎশক্তি বিদ্যুৎ কলকারখানার স্থবিরতা দূর করে শিল্পোৎপাদনের গতিকে ত্বরান্বিত করে। বিভিন্ন প্রকার শিল্প আজ তাদের সৃষ্টি কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডকে সুদৃড় করে বহির্বিশে^ আমদের অবস্থান উজ্জ্বল করছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের দেশের মোট জাতীয় আয়ের সিংহভাগই আসে গার্মেন্টস বা পোশাক শিল্প থেকে। আর বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়া পোশাক শিল্প অচল।

ঘ. মুদ্রণশিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহারঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর সাফল্য। এই মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে আজ হাজারো জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই প্রকাশিত হচ্ছে, যা আমাদের সভ্যতার অগ্রগতির অবদান রাখছে। তা ছাড়া মানুষ সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের তরতাজা, চাঞ্চর‌্যকর ও আনন্দদায়ক সংবাদ পাঠ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করছে। এগুলো ছাপার জন্য মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পূর্বে এ মুদ্রণযন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশনার কাজ চলত শম্বুক গতিতে। একটি ছোট আকারের প্রকাশনার জন্য মাসের পর মাস সময় লেগে যেত। বর্তমানে বিদ্যুৎ চালিত মুদ্যণযন্ত্রে হাজার হাজার ফর্মার মুদ্রণ কাজও অল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হয়।

ঙ. যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎঃ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর ও দ্রুত করা লক্ষ্যে প্রগতিশীল দেশগুলো তৈরি করেছে রেলগাড়ি ও আধুনিক কনকর্ড বিমান, যেগুলো, তৈরির, মূলে রয়েছে বিদ্যুতের অবদান। এ ছাড়া ভূ-গর্ভে স্থাপিত পাতাল রেল লাইনে দ্রুততম টিউব রেল চালু, করা হয়েছে, যা বিদ্যুতের সাহায্যেই চলে। অন্যদিকে আধুনিক তথ্য যোগযোগের অন্যতম মাধ্যম টেলিফোন, টেলিগ্রাম, ই-মেইল, ইন্টারনেট প্রভৃতির কার্যক্রম বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। এ ছাড়া আধুনিক ই-গভর্নেন্স, ই-ব্যাংকিং ও ফাইবার অপটিক যোগাযোগের মূলেও রয়েছে বিদ্যুৎ।

চ. চিকিৎসাক্ষেত্রে বিদ্যুৎঃ সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে চিকিৎসাক্ষেত্রে যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তাতে বিদ্যুতের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ মানবদেহের জটিল রোগ-ব্যাধি, যেমন-যক্ষ্মা, আলসার, ক্যান্সার, নিরসনে এবং কিডনি অপসারণ ও সংযোজন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় সেগুলো বিদ্যুতের সাহায্যে চালিত হয়ে থাকে। তা ছাড়া রঞ্জন-রশ্মি ও আলট্রাসনোগ্রাফির সাহায্যে মানবদেহের অদৃশ্য বস্তুকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সর্বোপরি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ শাখা শল্যচিকিৎসার কথা বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসায় বিভিন্ন থেরাপি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও আবশ্যকভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার হয়।

বিদ্যুতের ক্ষতিকর দিকঃ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের অসংখ্য উপকারিতার পাশাপাশি এর কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত বৈদ্যুতিক শক কেড়ে নেয় মানুষের মূল্যবান জীবন। তা ছাড়া অনেক সময় বৈদ্যুতিক তার থেকে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডের ফলে নষ্ট হয় কোটি টাকা মূল্যের ধন-সম্পদ, শিল্প কারখানা ও উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য। বিশেষজ্ঞদের নিবিড় পর্যবেক্ষণেও দেখা গেছে যে, উচ্চরোধের বিদ্যুবাহী তার থেকে বিকিরিত বিদ্যুতরঙ্গ প্রাণিদেহে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করতে পারে।



উপসংহারঃ বিদ্যুৎ আধুনিক জীবন ও সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি। এটি ছাড়া উন্নত ও অভিলাষী কল্পনা করা যায় না। মাইকেল ফ্যারাডে বলেন, “Electricity is the soul of civilization” অর্থাৎ বিদ্যুৎ হচ্ছে সভ্যতার প্রাণ। আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন খুবই কম। তদুপরি আমাদের অসচেতনতার কারণে যথেষ্ট বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। সরকার ও জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতীয় জীবনে উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যুতের স্বাভাবিক উৎপাদন ও এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

রচনাঃ বাংলা নববর্ষ
Previus
রচনাঃ বসন্তকাল
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম