শীতের সকাল অথবা, একটি শীতের সকাল-রচনা


শীতের সকাল অথবা, একটি শীতের সকাল


ভূমিকা: ঋতুচক্রের আবর্তে বাংলাদেশে শীত আসে। হেমন্তের ফসল ভরা মাঠ যখন শূন্য ও রিক্ত হয়ে পড়ে , তখনই বোঝা যায়, ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীত আসছে। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় ভর করে হাড়ে কাঁপন লাগিয়ে সে আসে তার নিজস্ব রুপ নিয়ে। প্রকৃতি তখন তার সমস্ত আবরণ খুলে ধারণ করে দীন হীন বেশ। প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয় এক ভিন্ন সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্য পূর্নতা পায় শীত সকালে।

শীতের সকালের আগমন: শীতের সকালের আবির্ভাব হয় কুয়াশাচ্ছন্ন অনন্য রূপ নিয়ে। পূর্ব দিকে আলোর সুষমা পুরেপুরি ফুটে উঠার আগেই পাখিদের হৃদয়ে তার গোপন সংবাদ সবার অলক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে স্বাগত জানাতে বনে বনে পাখির কন্ঠে ভেসে উঠে মধুর আবাহন - গীতি। একসময় কুয়াশার বুক ভেদ করে ফুটে উঠে আলোর রেখা। ভেসে আসে মুয়াজ্জিনে আযানের ধ্বনি। তীব্র শীতের কামড় উপেক্ষা করে র্ধমপ্রাণ মুসলমানরা ছুটে চলেন মসজিদে। গৃহত্যাগী গবাদি পশুর ডাক আর রাখালের পদচারণা শুরু হয়। লাঙল ও গরু নিয়ে কৃষকের মাঠে যায়। তাদের গায়ে থাকে সামান্য শীতবস্ত্র । অনেকের হয়তো তা-ও নেই। কাঁপতে কাঁপতে চলে মাঠে।

শীতের সকালের দৃশ্য: শীতের সকাল থাকে কুয়াশায় ঢাকা। দিগন্ত বিস্তৃত সাদা শাড়ি পরে কে যেন প্রকৃতিকে ঢেকে রাখে কুয়াশার আড়ালে । ঘড়ির দিকে তাকালে বোঝা যায় বেলা হয়েছে। সমস্ত প্রকৃতি থাকে শিশিরসিক্ত। বাইরে হাড়কাঁপানো কনকনে শীত। কাঁথা ছেড়ে উঠতে কিছুতেই মন চায় না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সূর্যের মুখ দেখার জন্য বারবার জানালার ফাঁকে উকি মারে। কোথাওবা আগুন পোহাবার দৃশ্য চোখে পড়ে। শীতের সকালের এক অসাধারণ আকর্ষণ সর্ষে ফুলের হলুদ মাঠ। সকালের সূর্যোলোক যেন তার নিপুণ হাতে প্রতিটি সর্ষে গাছকে নবরূপে ঢেলে সাজায়।

শীতের সকালে গ্রামাঞ্চল: গ্রামের মুক্ত প্রকৃতির কোলে শীতের সকাল যেন আড়মোড়া ভেঙে জেড়ে উঠে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর একটু আরাম করার জো নেই শীতের সকালে। শীতের সকাল গ্রামগঞ্জের মানুষের জন্য খুব কষ্টদায়ক। শীত নিবারণের মতো প্রয়োজনীয় কাপড় অনেকেরই থাকে না। শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে খুব সকালে তাদেরকে মাঠে-ময়দানে কাজে যেতে হয়। কৃষকেরা রবিকেরা পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। কিষাণ বধূরাও তখন ধান মাড়াই, ধান সিদ্ধ ইত্যাদি নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। সকালে গ্রামে গঞ্জে শীতের সকালে এক ধরণের ফেরিওয়ালা দেখা যায়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মোয়া-মুড়কি, ধরনের মিষ্টি, খেজুরের রস ইত্যাদির বিক্রি করে। শীতের সকালে সোনার রোদ হীরক জ্যোতি ছড়িয়ে দেয় মাঠে। সূর্যালোকিত শিশির কণাগুলো চোখে ধাধিয়ে দেয। এ দৃশ্য বড়ই মনোরম। শীতের সকালে নদী থেকে জলীয় বাষ্প যখন কুয়াশার সঙ্গে মিশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তখন এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়।

শীতের সকালে শহর : শীতের সাকলে শহরের অবস্থা ভিন্নতর। গ্রামের অনাবৃত দিগ›ত বিস্তৃত প্রকৃতির মাঝখানে শীতের সকাল যে সৌন্দর্য মহিমায় সেজে উঠে, শহরের ইট-পাথর ঘেরা কৃত্রিম পরিবেশ তার আভাস নেই। নিত্য দিনের কর্মচঞ্চলতা নিয়ে জেগে উঠে শহর। শিশির ভেজা কালো পিচের রাস্তায় হেডলাইট জ্বালিয়ে চালাতে হয় গাড়ি। রিকশাওয়ালা ঘন কুয়াশা কাটিয়ে ধীরে ধীরে রিকশা চালায়। রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানগুলোতে জমে উঠে ভিড়। হকার পত্রিকা নিয়ে ছুটে যায় দ্বারে দ্বারে। শিশিরসিক্ত পথে শীতের কাপড় জড়িয়ে রাস্তায় বের হয় লোকজন। তাদের পোশাকের কত না বৈবিত্র। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নান রং বেরঙের শীতের পোশাক পড়ে ছুটতে থাকে বিদ্যালয়ে পানে। অরদিকে শহরের বস্তিতে শীত আসে নির্মমতা নিয়ে। শীত নিবারণের কোন ব্যব¯থা তাদের থাকে না। নির্মম শীতে তারা কাঁপতে থাকে ঠক্ ঠক্ করে।

শীতের সকালে উপভোগ:  শীতের সকালে চিঁড়া মুড়ি খেতে খুব ভালো লাগে। কোচর ভরা চিঁড়া মুড়ি নিয়ে শীতের সকালের রোদকে উপভোগ করার দৃশ্য গ্রামে বাংলায় প্রায়ই দেখা যায়। এ সমস্ত্র ঘরে ঘরে তৈরি হয় হরেক রকমের পিঠা। শীতে গরম গরম পিঠা ভারি মজা। কবি সুফিয়া কামালের ভাষায়-

“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে আরও উল্লাস বাড়িয়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”

শীতেরর সকালে খেজুরগাছ থেকে যে তাজা রস নামায় তা পান করা খুবই তুপ্তিকর। আর খেজুর রস দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস খুবই মজাদার। শীতরে সকালের আরো অনেক উপভোগ্য জিনিস বর্তমান। শীতের সকালে রোদের বিপরিতে বসে জমাট বাঁধা মাছের তরকারি দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার মধ্যেও রয়েছে এক অনাবিল সুখও আনন্দ।

শীতর প্রভাব: শীতের সকাল মানবজীবনের ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। শৈতাপ্রবাহে অসুবিধা সৃষ্টি হলেও মানুষের কাছে শীতের মনোরম সকাল পরম উপভোগ্য বলে বিবেচিত হয়। শীতের সকাল আসে নির্জনতা নিয়ে। বৈরাগ্যবেশ ধারণ করে প্রকৃতি। চারদিকে রিক্ততার সুর প্রতিধ্বনিত হয়। মানুষ তখন কোলাহল - মুখরিত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবুও প্রকৃতির শিশিরঝরা রূপটি মানুষের কাছে এক অনবিল সৌন্দর্য নিয়ে উপভোগ্য হয়ে উঠে। শীতের সকালের শীতল হাওয়া আর শিশির স্নিগ্ধ পরিবেশ মানুষের জীবনের বিস্তার করে প্রগাঢ় শান্তির মায়াজাল। শীতের রবি-শস্যের প্রাচুর্য মানুষকে উপহার দেয় আহারের পরিতৃপ্তি। আবহাওয়ার স্নিগ্ধতায় মানুষের জীবন তখন হয়ে উঠে একান্ত উপভোগ্য । মনের আনন্দের খোঁজে মানুষ বনভোজনে চলে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে। শীতের সকাল এক অনাবিল প্রশান্তি আনে মানুষের জীবনে।

উপসংহার:  শীতের সকালের একটা চিরন্তর সৌন্দর্য ও মাধুর্য রয়েছে। রাতের অবসানের সাথে সাথে শীতের সকাল তার অনবদ্য সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে। এক সময় সূর্য উঠে , ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে রোদ, বাড়তে থাকে উত্তাপ। রাতের ঝরা শিশির তার কর্তব্য শেষে উধাও হয়। শীতের প্রভাব কাটিয়ে মানুষ বেরিয়ে পড়ে নিজ নিজ কাজে। শুরু হয় কর্মমুখর জীবনের ব্যস্ততা। শরীর থেকে মুছে ফেলে কুয়াশা ঘেরা শীতের সকাল।

ষড়ঋতু অথবা, বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য - রচনা
Previus
শ্রমের মর্যাদা- বাংলা রচনা/প্রবন্ধ
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম