বাংলা রচনাঃ বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার
বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার
প্রারম্ভিকাঃ শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানের আলো দান করে, সমাজ থেকে কুসংস্খার দূরে করে মানুষে মানুষে সম্প্রীতে বাড়ায় এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে করে সমৃদ্ধ। তাই শিক্ষা জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। জীবনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষাই কর্মমুখী শিক্ষা। আজ পৃথিবী দ্রুতবেগে এগিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার সাথে কর্মমুখী শিক্ষার অগ্রযাত্রার ফলেই তা সম্ভব হচ্ছে কর্মের জন্যই আজ বিশে^ কর্মমুখী শিক্ষা অতীব প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশে বেকারত্বের কারণঃ বিগত বছরগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশের বেকার সমস্যাকে সুদৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা সৃষ্টির পিছনে যেসব দায়ী সেগুলো হলোঃ
দুর্বল অর্থনীতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী নয়। এজন্য দেশে শিল্প কারখানা ব্যবসা-বানিজ্য ও উন্নয়মূলক কাজের প্রসার ঘটছে না। আমাদের দেশে বর্তমানে এমনিতেই অসংখ্য লোক বেকার তদুপরি যে হারে আমাদের দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। তাই দিন দিন বেকারের সংখ্যা বেড়াই চলেছে।
কৃষি নির্ভরতাঃ আমদের দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কৃষিপ্রদান এ দেশে শতকরা ৮৫ ভাগ লোক কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু অনুন্নত কৃষিব্যবস্থা আমাদের অর্থনীতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কৃষি ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজের বাবস্থা না থাকায় বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
কুটির শিল্পের অবলুপ্তিঃ আমদের সরকারি পুঁজি বা বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ঋণের সিংহভাগই চমক লাগানো অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হয়। এতে সাময়িকভাবে কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ হলেও স্থায়ী কর্মসং¯থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। তা ছাড়া কুটির শিল্পের কাঁচামাল আসে কৃষি থেকে। কিন্তু কৃষির অনগ্রসরতার দরুন কৃষিখাত উৎপাদন বহুগুণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কাঁচামালের যোগানের অভাবে দিন দিন দেশের কুটির শিল্প বিলুপ্ত হচ্ছে। শিল্পায়ন, বাণিজ্য এবং যুগ্লোপযোগী পণ্য উৎপাদনের অভাবে এদেশের কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সে করণে কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়ছে।
কারিগরি জ্ঞানের অভাবঃ বাংলাদেশের শ্রমজীবী শ্রেণির অধিকাংশই নিরক্ষর ও কারিগরি জ্ঞানের দক্ষতা বর্জিত। সে জন্য তারা যেমন কোনো কর্মসং¯থান পায় না তেমনি নিজেরাও কিছু কারতে পারে না। তা ছাড়া দেশের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা চাকরি ছাড়া অন্য কোনো শ্রমসাধ্য কাজ করতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অনুন্নত ও কৃষিনির্ভর। ফলে এদেশে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। তাই চাকরির অভাবে শিক্ষিত যুব সম্প্রায়ের অনেকেই বেকার থাকছে।
ব্যবসাক্ষেত্রে অনাগ্রহঃ সময়ের বিবর্তণে মানুষের পছন্দের পরিবর্তন ঘটছে। বর্তমান ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ব্যক্তিগণ ব্যবসা- বানিজ্য অংশ না নিয়ে চাকরির প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ছে। চাকরির আকাক্সক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বিমুখতা বেকার সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলছে।
মধ্যবিত্তদের অবস্থানঃ কর্মহীন শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কারণে বেকার সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। আমাদের কৃষকরা বছরের কয়েক মাস ঘরে বসেই দিনাতিপাত করে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরা শ্রমশিল্প ও কৃষিকাজে অনভ্যস্ত। তারা চাকরির প্রতি সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রেও তারা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে বেকারত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে।
অস্বাস্থ্য ও অপুষ্টিঃ বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ অস্বাস্থ্য ও অপুষ্ঠিজনিত সমস্যার শিকার। ফলে তারা দিন দিন তাদের কর্মদক্ষমতা হারিয়ে বেকারত্বের শিকার হচ্ছে।
বেকারত্বের প্রভাবঃ বাংলাদেশের সর্বত্র বেকারত্বের ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার লাভ করছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট অভিশাপ। বেকারত্বের দরুণ আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার ক্রমাগত বাড়ছে। এ দেশের শতকরা প্রায় ২৪ ভাগ লোই দরিদ্র। বেকারত্বের কারণে এ অবস্থা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া বেকারত্বের দরুন অধিকাংশ মানুষের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তারা নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাজে লিপ্ত হচ্ছে। তাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও কলহ বেড়েই চলেছে। বেকারত্বের শিকার হয়ে অসংখ্য ব্যক্তি সামজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে আমাদের জাতীয় সম্পদের বিপুল পরিমাণ অপচয় হচ্ছে, যা জাতীয় উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া বোকরত্ব আমাদের যুবসমাজের মাঝে হতাশা সৃষ্টি করছে। ফলে তারা দেশ, সমাজ, ও আইনের প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এর ফলে সমাজ ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। বেকারত্বের অসহনীয় যাতনা মানুষের মনে হতাশা ও সামজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার করে। পরিণামে ব্যক্তি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে। বেকারত্বজনিত দুঃসহ যাতনা ও মানসিক পীড়াকে ভুলে থাকার ভুল প্রচেষ্টা হিসেবে অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে সমাজ জুড়ে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বেকার সমস্যা সমাধানের উপায় ঃ বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের পক্ষে সীমিত সম্পদ নিয়ে বেকারত্ব মোকাবেলা করা খুবই কষ্টসাধ্য। তাই বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ব্যতীত কোনোভাবেই বেকার সমস্যার আশা করা যায়। এ সমস্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানকল্পে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন- প্রকৃতিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা বাদ দিয়ে কৃষিকে একটি নির্ভরশীল ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিপন্ন হতে হবে। কুটর শিল্প ও বৃহদায়তন শিল্প কারখানা স্থাপন করে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রকৃতিক সম্পদের সুষম বন্টনের দিকে মনোযোগী হতে হবে। বাংলাদেশের জনশক্তিকে বোঝা না বানিয়ে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। শিল্পক্ষেত্রের মােত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমশক্তির বাজার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বোপরি সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই লোক নিয়োগের ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।
উপসংহারঃ বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। এযুগে কর্মমুখী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই একমাত্র কর্মমুখী শিক্ষাই দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে। শিক্ষার উদ্দেশ্য শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ সাধন। সাধারণ শিক্ষায় মানসিক বিকাশ ঘটে আর কর্মমুখী শিক্ষায় শারীরিক উন্নতি আসে। এমনি করে জীবনের সাথে শিক্ষার সমন্বয়ে জীবন হয় সমৃদ্ধ।
Share This Post