বিজ্ঞানের জয়যাত্রা - রচনা
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা
বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবন
দৈনন্দিন / প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান
মানব কল্যাণে বিজ্ঞান
ভূমিকা: বর্তমান যুগ বিজ্ঞারেনর যুগ। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় গতি, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে করেছে দ্রুততর ও বহুমাত্রিক। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের জাদুকরী স্পর্শে মনবজীবনের সর্বত্র এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সর্বক্ষেত্রে আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে বিজ্ঞানের অব্যাহত জয়যাত্রা। মানব কল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান যে কত ব্যাপক তা প্রতিদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করা যায়। বিজ্ঞানের কল্যাণে আমাদে দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক ক্ষেত্রে এসেছে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।
বিজ্ঞান কথাটির অর্থ : ‘বিজ্ঞান’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে 'Science' যা ল্যাটিন শব্দ 'Scio' থেকে এসেছে। এর অর্থ জানা বা শিক্ষা লাভ করা । আভিধানিক অর্থে বিশেষ জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান। মনীষী স্পেন্সারের মতে, বিজ্ঞান হলো সুশৃঙ্খল ও সুসবদ্ধ জ্ঞান। অনুসন্ধিংসু মানুষের বস্তুজগৎ সম্পর্কে ধারণা এবং বিচিত্র কৌশলে তার উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকেই উদ্ভব ঘটেছে বিজ্ঞানের। এটি হয়েছে মানুষেরই প্রয়োজনে, তার অভাব মেটানোর তাড়না থেকে। এভাবে সভ্যতার বিকাশের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠার মাধ্যমে বিজ্ঞান ক্রমেই মানুষের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।
জীবন ও বিজ্ঞান: প্রয়োজনই উদ্ভাবনের প্রেরণা জোগায় । মানুষের অভাববোধ থেকে বিশেষ জ্ঞান হিসেবে বিজ্ঞানের উৎপত্তি। তাই জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক যেমন পুরোনো, তেমনি নিবিড়। মাুনষের অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা ও আগ্রহ থেকে বিজ্ঞানের বিচিত্র বিকাশ। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদে সংস্কার, বিশ্বাস ও প্রবণতা বদলে যাচ্ছে। আজ বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে আমরা সব কিছু যাচাই করে দেখতে চাই, প্রমাণ পেতে চাই অনেক কিছুর। এ জিজ্ঞাসা ও তর্কের প্রবৃত্তি আমাদের বৈজ্ঞানিক পরিবেশের ফসল। সুতরাং বিজ্ঞান সম্পর্কে আমরা যতই অজ্ঞ হই না কেন, বিজ্ঞানের প্রভাব আমাদের জীবনের মর্মমূলে প্রবেশ করেছে।
বিজ্ঞানের গুরুত্ব: মানবসমাজের যে দিকেই দৃষ্টিপাত করা যায়, শুধু বিজ্ঞানের মহিমাই স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিজ্ঞানের বলে মানুষ জল-স্থর, অন্তরীক্ষ জয় করেছে; সংকট নিরসন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের বহু অভাবনীয কৌশল আবিষ্কার করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের গৌরবময় অবদান বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে আছে এবং মানবজীবনের উপর এর সুগভীর প্রভাব পড়ছে। মানবজীবনকে অফুরন্ত সুখে পরিপূর্ণ করে তোলার সাধনায় সদা নিয়োজিত বিজ্ঞান তার বিস্ময়কর আবিষ্কার চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। এ সাধনা যেমন ক্রমাগতভাবে চলছে, তেমনি তার কল্যাণকর সুফল ও নিবেদিত হচ্ছে মানুষের সেবায়। বিজ্ঞান আজ মৃত্যুকে জয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের কর্মসাধনার পরিণতি হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা। বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ আজ আকাশ ও পাতালকে সাজিয়েছে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে। তারা জীবনকে জয় করে মৃত্যুকে পদানত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে নব সব কৌশল ও প্রকারণ প্রবর্তণের মাধ্যমে এ জগতে বিজ্ঞান এনেছে যুগান্তন; দূরকে করেছে আপন আর জীবনকে করেছে সহজ।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান: চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য আজ মানুষ অকাল মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্ম ইত্যাদি মনণব্যাধির সু-চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। উন্নত মানের ঔষুধ, অস্ত্রোপচার ব্যবস্থা, এক্সরে, আলট্রাভায়োলেটরে, অনুবীক্ষণ যন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এসেছে এক আমূল পরিবর্তন। উন্নত চিকিৎসা সেবার ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের গড় আয়ু। কম্পিউটারকেন্দ্রক টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতেম পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকেযে কোনো ব্যক্তি উন্নত দেশের ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে সুস্থ থাকতে পারছে। আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।অ অবলীলায় করা হচ্ছে ওপেন হার্ট সার্জরি ,শরীর না কেটে বাইপাস সার্জারি, প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে এাকজনের অঙ্গ অন্যজনের শরীরে। বিজ্ঞানের কল্যাণের মানুষের জেনেটিক স্বরুপ উদঘাটনের দ্বারাপ্রান্ত পৌঁছে গেছে বিজ্ঞানীরা, যা চিকিৎসা চিজ্ঞানে বয়ে আনবে যুগান্তকারী বিপ্লব।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান: আধুনিক বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রেও অশেষ উন্নতি সাধন করেছে। প্রাচীন ভোঁতা লাঙলের পরিবর্তে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নতি মানের কলের লাঙল ও ট্রাক্টর। ফসলের উৎপাদন ও মান বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃহ হচ্ছে আধুনিক রাসায়নিক সার। কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত মানের কীটনাশক । প্রকৃতির দয়ার উপর নির্ভর শীল না হয়ে গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহার্য্যে পানি সেচের ব্যবস্তা করা হচ্ছে। গবেষাণার মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে উন্নত মানের বীজ। তা ছাড়া খরা, শীত ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন কৃষি উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লােবর সূত্রপাত ঘটিয়েছে। ফলে ধান, গমসহ সকল প্রকার খাদ্যশস্যের উৎপাদন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত জাতের মাছ, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি উদ্ভাবনের ফলে এসবের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে অভাবনীয় হারে। এভাবে বিজ্ঞান আজ উর্বরতা দিয়ে ক্ষযিষ্ণু বসুধাকে শস্যবতী করে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
যোগাযোগক্ষেত্রে বিজ্ঞান: আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার পুরোটাই বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বুলেট ট্রেন, আধুনিক কনকর্ড বিমান, মাটির তলায় ধাবমান টিউব রেল সবই বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞানের অবদানেই আজ আমরা এরোপ্লেনে চড়ে শূন্যাকাশে শত শত মাইল পাড়ি দিচ্ছি, যা এক সময় ছিল বিজ্ঞানের অবদান। তাছাড়া এখন আমরা হাতের মোবাইল টিপে মুর্হুতের মধ্যে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে অবস্থিত ব্যক্তির সাথে কথা বলা, ছবি পাঠানো ও ভিডিও কল করতে পারি। সারা বিশ্বের প্রতি মুহুর্তের সংবাদও এখন আমরা মোবইলে পাই। যা বিজ্ঞানেরই আর্শীবাদ।
শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান: একদা মানুষ জীবনের প্রয়েজনীয় উপকরণ সংয়গ্রহ ও উৎপাদনে কায়িক শ্রমের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। এতে মানুষের কাজ করতে অধিক সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হতো। কিন্তু এর তুলনায় কাজ হতো কম। বিজ্ঞানের কল্যাণে শিল্পবিপ্লবের ফলে কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে, বেড়েছে উৎপাদন, লাঘব হয়েছে মানুষের কায়িক শ্রম। উৎপাদনের সর্বক্ষেত্রে আজ বিরাজ করছে যন্ত্রের আধিপত্য। ফলে মানুষ স্বস্তি ও আয়াসপূর্ণ জীবন। শত মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় যা আগে করার চেষ্টা করা হতো এখন তা যন্ত্রের বোতাম টিপে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কর্মের স্থানটিও দখল করে নিচ্ছে কর্মী রোবট।
প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: বিজ্ঞানের কল্যাণস্পর্শে প্রকৃতির অনেক ধ্বংসাত্মক দিককে মানুষ কল্যাণকর দিকে পরিবর্তিত করতে সক্ষম হয়েছে। বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উইন্ডমিলের মাধ্যমে মানুষ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু করছে। মোটকথা, বিজ্ঞানের কল্যাণে একসময়ের ভয়ংকরী প্রকৃতি আজ শুভংকরী প্রেয়সীতে রুপান্তরিত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান: দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশ। রেডিও, টেলিভিশণ, সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ , বৈদ্যুতিক ইন্ত্রি, বৈদ্যুতিক হিটার ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে আমাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সহজ ও আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। অফিস-আদালতে নিত্য ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার, ফটোস্ট্যাট মেশিন, টেলেক্স, ফ্যাক্স ইত্যাদি যন্ত্রপাতি। এমনিভাবে বিজ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কত রকম প্রয়োজন যে মেটাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।
বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিক: বিজ্ঞান একদিকে যেমন মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধন করে আসছে, অন্যদিকে তেমনি এনেছে বিভীষিকা। যন্ত্রের উপর নির্ভর করতে করতে মানুষের জীবনে এসেছে যন্ত্রনির্ভরতা, কর্মবিমুখতা। এটি অনেক ক্ষেত্রে বেকার সমস্যা বাড়িয়ে তুলেছে। ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টিলিভিশনের মতো আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ ঘটছে বিজাতীয় অপসংস্কৃতির । এতে করে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার আজ মানব ফলে মানবজীবনে বিজ্ঞান অভিশাপ পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকায় বোমা বর্ষণের পর জাপারের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের ধ্বংসযজ্ঞ তারই বাস্তব প্রমাণ।
উপসংহার: বর্তমান সভ্যতা বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞান আমাদের সুখ-সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করেছে গতিময়। মানব জাতি বর্তমান প্রতি মুহুর্তে পদক্ষেপে বিজ্ঞানের কাছে ,দায়বদ্ধ। কাঁটা ছাড়া যেমন গোলাপ হয় না। তেমনি বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই সভ্যতার জন্য মঙ্গলজনক নয়। তবে এটি অনেকটাই নির্ভর করে ব্যবহারকারীর সদিচ্ছার উপর। বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্বভ হলে অদূর ভবিষ্যতে মানব সভ্যতা সমৃদ্ধি ও উন্নতির চরম শিখরে পৌছে যাবে।
Previus
Next
Share This Post