রচনা (প্রবন্ধ) “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
ভূমিকাঃ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নামক রাষ্ট্রে পরিচিতি এক গৌরবময় বিজয়গাঁথা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের এ স্বাধীনতার রয়েছে সুদীর্ঘ রক্তঝরা ইতিহাস। এ স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া একমুঠো মুক্তো বা বদান্যতার উপহার নয়। এক সাগর রক্ত ও ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া একমুঠো মুক্তো বা বদান্যতার উপহার নয়। এক সাগর রক্ত ও ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা। মুক্তিসেনার রক্তে রঞ্জিত এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে অনেক সংগ্রামী চেতনা বিজড়িত। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিঃ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের দু:শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার মাধ্যমে এদেশকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানলে বাঙালি জাতি তাদের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে কঠোর ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে পাকিস্তানের বাংলা ভাষাকে ন্যায্য মর্যাদা বাধ্য হয়। এতে বাঙালির বুঝতে পারে, আন্দোলন ছাড়া পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ন্যায্য অধিকার দেবে না। পরবর্তীতে শাসকগোষ্ঠী নানা অন্যায় অত্যাচার করলে বাঙালি জাতি তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এ ভাবে ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছফ দফা আন্দোলন ১৯৬৯ সালে গন আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ ১১ দফায় ভিওিতে নির্বাচনের অংশগ্রহন করে এবং উভয় পরিষদেই পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের এ বিজয়ে আথঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর টালবাহানা শুরু করে। এর ফলে সারাদেশে বিভোক্ষ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এতে আন্দোলন আর ও বেগবান হয়। ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া মুজিব বৈঠক ব্যর্থ হলে ২৫ মার্চ গভীর রাতে সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর গনহত্যা চালায়। ২৫ শে মার্চ রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে করাচিত্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।স্বাধীনতার ঘোষণাঃ পাকিস্তানের সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। বঙ্গবন্ধু এ ঘোষণা দেশবাসীকে জানানোর জন্য চট্রগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান ২৬ মার্চ দুপুরে চট্রগ্রাম বেতার থেকে তা প্রচার তা প্রচার করেন। পরে চট্রগ্রামের কালুরঘাটে চালুকৃত স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
গনপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠনঃ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আনুষ্ঠানিক বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহন করে। রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন উপ- রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম । প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহম্মদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন এ এইস এম কামরুজ্জামান। ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। কর্নেল এম. এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনাঃ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির উপর হামলা চালানোর পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তারা মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহন করে । এ সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক সেক্টরে একজন কমান্ডারের নেতৃত্ব মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর উপর আক্রমন ও সম্মুখ যুদ্ধ শুরু করে। আবার পাক বাহিনীর অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া অনেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। দেশের আপামর জনসাধানণ মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করে। ফলে মুক্তিসংগ্রাম সর্বজনীন গনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। আবার পাক বাহিনীর অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া অনেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে গেরিলা আক্রমন শুরু করে। দেশের আপামর জন সাধারণ মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে। ফলে মুক্তিসংগ্রাম সর্বজনীন গণযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। আর এভাবে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি বাহিনী অপদস্ত হতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতাঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। পাক বাহিনীর অত্যাচারে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার এ সকল উদ্বান্তুদর খাদ্য, বস্ত্র,ঔষধ দিয়ে সাহায্য করে। রাশিয়া সরকার সহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকার এ জনগন বাংলাদেশকে সহযোগিতা পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী পাক বাহিনীর নির্যাতন হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই পরাশক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে ও তাদের জনগন বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে। অবশেষে বৈদেশিক সাহায্য ও মুক্তিবাহিনী নিরলস চেষ্টার নয় মাসে বাংলাদেশে স্বাধীন হয়।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণঃ ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হয়ে উঠে। ৩ ডিসেম্ভর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৪ ডিসেম্ভর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াতে শুরু করে। ৬ ডিসেম্ভর ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। ৪ ডিসেম্ভর থেকে ১২ ডিসেম্ভর মধ্যে বাংলায় পাকবাহিনীর সবগুলো বিমান বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। এ ভাবে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ১৩ ডিসেম্ভর মধ্যে পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চূড়ান্ত বিজয়ঃ ১৪ ডিসেম্ভর যৌথবাহিনী ঢাকার মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৬ ডিসেম্ভর হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী তার ৯৪ হাজার সৈন্য নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ সোহরাওয়াদী উদ্যানে যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসর্মপণ করে। আর এভাবেই বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। উপসংহারঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো খন্ডিত বিচ্ছিন্ন স্বপ্ন বা কল্পনার বাস্তবরুপ নয়। ঐক্যবদ্ধ জীবন প্রচেষ্টা মিলন- বিরহ, আশা নিরাশার বাস্তব অনুভূতি সম্ভলিত এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী অপরাজেয় চেতনা মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ আর দুলক্ষ মা বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয়েছে। আর আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা সম্দ্ধৃ বাংলাদেশ নামের একটি নতুন ও স্বাধীন ভূখন্ড।
Previus
Next
Share This Post