স্বদেশ প্রেম (দেশপ্রেম) -রচনা (প্রবন্ধ)
স্বদেশ প্রেম অথবা, দেশপ্রেম
ভূমিকা:“স্বদেশের উপকারে নাই যার মন, কে বলে মানুষ তাে পশু সেই জন।”
স্বদেশপ্রেম হলো নিজ দেশের প্রতি এক ধরণের অনুরাগময় পরিত্র ভাবাবেগ। এটি মানব চরিত্রের সুকুমার বৃত্তিগুলোর অন্যতম। মানুষের মধ্যে সহজাতভাবেই এ গুণের উদ্ভব হয়। সুষ্ঠু শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এ গুণের বিকাশ ঘটে। দেশপ্রেম দেশের মঙ্গল ও উন্নতির জন্য সবকিছু সঠিক ও নিয়মসিদ্ধভাবে করতে মানুষকে উৎসাহিত করে। তাই মানব চরিত্রের এ বিশেষ গুণটির অনুশীলন দেশ, জাতি তথা বিশ্বের জন্য কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনতে সক্ষম। দেশপ্রেমের স্বরূপঃ যে দেশের জন্ম, বড় হওয়া, জীবন অতিবাহিত করা, তা-ই তো স্বদেশ। আর স্বদেশ বা নিজের দেশের প্রতি মানুষের সুগভীর অনুরাগ বা ভালোবাসার নামই স্বদেশপ্রেম। স্বদেশ মায়ের সাথে তুলনীয়। মা যেমন তার সন্তানকে জন্মের পর থেকে অসীম মমতায় আগলে রাখে লালন- পালন করেন, তেমনি স্বদেশও তার বুকে ধারণ করে আলো-বাতাশ. অন্ন-জলে আমাদের লালন-পলান করে। পৃথিবীর বিভিন্ন মনীষীর স্বদেশপ্রেম সম্পর্কিত মতামত পর্যালোচনা করলে স্বদেশপ্রেম প্রকাশই তিনটি প্রধান মাধমের কথা জানা যায়। এগুলো হচ্ছে মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি। তাই বলা যায় মা, মাতৃভাষা ওমাতৃভূমির প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসার সমন্বয়ই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম।
স্বদেশপ্রেমের বিকাশঃ মা, মাতৃভাষাএবং মাতৃভূমি স্বদেশপ্রেম বিকাশের ধারাবহিক প্রক্রিয়ার এককটির পর্যায়। এ পর্যায়সমূহ সফলতার সাতে অতিক্রমের মাধ্যমে একজন মানুষ তার স্বদেশপ্রেমের পরিপূর্ন বিকাশ ঘটাতে পারে। মা দশমাস গর্ভধারণ করে অনেক কষ্টের মাঝেও পরম মমতায় আমাদের পৃথিবীর আলো দেখান। মায়ের সাথে আমাদের রয়েছে নাড়ির বন্ধন, যা কোনোভাবেই ছিন্ন হবার নই। সন্তানের প্রতি মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা সন্তানকে শেখায় ভালোবাসাতে। মায়ের স্নেহ প্রসূত ভালোবাসার এ পাঠ মানুষের মাধ্যে স্বদেশপ্রেমের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে। “ যে ভাষাতে প্রথম বোলো ডাকনু মায়ে মা বলে” সে ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার বর্ণালি ছটায় আমরা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করি আমাদের অন্তরের অনুভুতি ও আকুতি । মাতৃভাষাকে ভালোবেসে ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে অন্তরের অন্তস্থলে অধিষ্ঠিত করার দ্বারা মানুষের স্বদেশপ্রেমের বিকাশ পরিপূর্ণতার দিকে আরেক ধাপ অগ্রসর হয়। বৃহত্তম অর্থে মানুষ ধরিত্রীর সন্তান। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পৃথিবী তার জন্মপরিচয়ের ঠিকানা নয়। পৃথিবীর নির্দিষ্ট যে ভূ-খন্ডে মানুষ জন্মগ্রহণ করে , যে মাটির আলো-বাতাস, অন্ন-জলে সে বেড়ে উঠে, তা-ই তার জন্মভূমি তথা মাতৃভূমি। জন্মভূমির ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশ , ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির সাথে পরিচিত হতে হতে জন্মভূমির এক চির আরাধ্য , চির পবিত্র, চির ভাস্বর মাতৃসম ভাবমূর্তি গড়ে উঠে মানুষের হৃদয়ে। অতঃপর সেই তীব্র আবেগ স্বদেশ বন্দনার বাণী হয়ে ঝরে পড়ে।
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগ্যে তোমাই ভালোবেসে।”
দেশপ্রেমের গুরুত্ব: স্বদেশপ্রেম এমন একটি গুণ, যা একজন মানুষকে দেশের কল্যাণর্থে তার স্বার্থ, স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ এমনকি নিজ জীবন উৎসবর্গ কতে অনুপ্রাণিত করে। স্বদেশপ্রেমের অনন্ত স্পৃহ মানুষকে দায়িত্বপরায়ণ , উদ্যমী ওগভীর আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। দেশপ্রেমীক দেশবাসীর দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত ও সম্মানিত হন। ফলে মানুষের মধ্যে জাতির কল্যাণ চিন্তা জাগ্রত হয়। দেশপ্রেমের মহৎ চেতনায় উদ্বদ্ধ হয়ে প্রতিটি মানুষ তার স্ব স্ব অবস্থানে থেকে দেশের জন্য কাজ করে। একটি সমৃদ্ধ জাতি, উন্নত দেশ, সুখী মানুষ সবই স্বদেশপ্রেমের অবদান। অন্যদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেন, “হুববুল ওয়াতান মিনাল ঈমান” অর্থাৎ “স্বদেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। ” অন্যান্য ধমেও একইবাবে স্বদেশপ্রেমকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। স্বদেশপ্রেমের মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আত্মোৎসর্গকারী ব্যক্তি অমর হয়ে থাকেন।স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত: ইতিহাস থেকে জানা যায় , দেশপ্রেমে উদ্বদ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক মহাপুরুষ বিভিন্নভাবে নজির স্থাপন করে গেছেন। নিজ দেশের পবিত্র মাটিকে শত্রু র বিষাক্ত নিঃশ্বাস থেকে মুক্ত করতে অনেক দেশপ্রেমিক নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। স্বদেশের মাটি থেকে ইংরেজদের তাড়াতে গিয়ে তিতুমীর হাসিমুখে তার বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, স্বদেশের গান গেয়ে বালক ক্ষুদিরাম ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছিলেন, নজরুল কারাগারের শিকল ভাঙার গাণ গেয়েছিলেন। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য শহিদ হয়েছেন, রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার প্রমুখ। বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুবার কারাবরণ করেছিলেন। স্বদেশের স্বাধীনতার রক্ষায় এদেশেলর ত্রিশ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন , দুই লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছিলেন। অর্থাৎ দেশমাতৃকার প্রেমে উদ্বদ্ধ হয়ে এরা স্বদেশের বৃহৎ স্বার্থে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। তাছাড়া রানা প্রতাপ, শিবাজী, প্রফুল্ল চাকী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার , নেতাজী সৃভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ দেশপ্রেমিক নিজেদের জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম: নদী যেমন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে দুর্বার বেগে ছুটে চলে সাগর পানে, তেমনি স্বদেশপ্রেমের মহিমান্বিত বীণার তারে মুহুর্মুহু অনুরণিত হয় বিশ্বপ্রেমের অনিন্দ্য সুরমূর্ছনা। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। স্বাধেশবাসীকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্ববাসীকে ভালোবাসতে শেখে। ‘জাতি-ধর্ম - বর্ণ, সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষ’ বিশ্বপ্রেমের এই বাণীকে জাতীয় জীবনে গ্রহণ করলেই সংকীর্ণ অন্ধ জাতীয়তাবোধ থেকে আমাদের মুক্তি আসবে। বিশ্বকবির লেখায়ও আমরা সে কথারই প্রমাণ পাই-
“ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা তোমাতে বিশ্বময়ীর - তোমতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।”
দেশপ্রেমের নামে নৈরাজ্য: স্বদেশপ্রেম হবে নিষ্কলুষ ও নির্লোভ। কিন্তু স্বদেশপ্রেমের মহান এ আদর্শ বিস্মৃত হয়ে দেশপ্রেমের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে অনেকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, অনেক রাষ্ট্রনায়ক কায়েম করে একনায়কতন্ত্র । এরা দেশপ্রেমিক নয়, বরং এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের কারণেই দেশ ও জাতি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। ইতালির মুসোলিনি, জার্মানির হিটলার, এরা স্বদেশপ্রেমের ইতিহাসে কলঙ্ক । এরা কেবল নিজের দেশের অশ্রুই ঝরায়নি, বিশ্বমায়েরও অশ্রু ঝরিয়েছে। তাই মানুষ তাদের কথা স্মরণ করে সুতীব্র ঘৃণার সাথে।উপসংহার: স্বদেশপ্রেম মানুষকে স্বার্থপরতা, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভোদাভেদের ঊর্ধ্বে তুলে এক স্বপ্নিল ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে সক্ষম করে তোলে। অসংখ্যা স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিকের আত্মদানে ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ আজ স্বাধীর ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের সামনে আজ একবিংশ শতাব্দির নতুন চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সকল জড়তা ও পশ্চাৎপদতাকে পেছনে ফেলে শৌর্য-বীর্য-সমৃদ্ধিতে বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর । এজন্য আমাদেরকে দেশ গঠনের কাজে স্বদেশপ্রেমে উদ্বদ্ধ ও সমবেত হয়ে ঐক্যবন্ধ জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
Share This Post