রচনা(প্রবন্ধ)“ডিজিটাল বাংলাদেশে”
ডিজিটাল বাংলাদেশে
ভূমিকাঃ একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অচ্ছেদ্য চলিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে পৃথিবী আজ একটি ডিজিটাল গ্রহে পরিনত হতে যাচ্ছে। বিশ্বায়ন এবং তথ ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যাপক অগ্রগতির ফলে বিশ্বের জাতিসমূহ আজ পরস্পরের অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছে। এ বিপুল স্রােতধারা থেকে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ বাংলাদেশ’ এ রূপান্তরের কর্মপরিকল্পনা ঘোষনা করেছে। ডিজিটালকরণ ও জনমতঃ বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেক হাসিনা ২০০৮ সালে তাঁর নির্বাচনি প্রচারণায় বাংলাদেশকে ডিজিটালকরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তারপর থেকে এ শব্দটি বাংলার সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। মিডিয়া, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, হাট-বাজারে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি সর্বাধিক প্রচলিত শব্দে পরিণত হয়। বাংলাাদেশের সাধারণ মানুষ ‘ডিজিটাল’ কথাটির অর্থ বুজতে না পারলেও এর অঙ্গে পরিবর্তনের যে একটা সম্পর্ক রয়েছে তা ঠিক বুঝতে পারে। বাংলাদেশের জনগণে ধারণা এ ডিজিটালকরণেভর মাধ্যমে এবার বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যাসমূহ যেমন- দুর্নীতি , বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতি সমস্যঅগুলো দূরীভুত হবে । অর্থাৎ ডিজিটালকরণ বলতে আমরা পরিবর্তনকেই ধরে নিতে পারি।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বরুপঃ ডিজিটাল কথাটি তথ্যনির্ভর একটি পদ্ধতিতে নির্দেশ করে। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ দ্বারা বাংলাদেশের এমন এক সমাজের কথা বোজানো হয় যার ভিওি হবে জ্ঞান। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পরিচালিত এমন একটি জ্ঞানভিওিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো তথ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া এ ধরনের একটি সমাজে সরাসরি, আধা – সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্ষেত্রে সমূহের সকল কাজ কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচালিত হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বর্তমান অবস্থাঃ বিশ্বায়ন এবং তথ্য ও যোগাযোগে প্রযুক্তির সম্প্রসারণের ফলে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বহিবিশের্^র সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিশ^ব্যাপী ইন্টারনেট সুপার হাইওয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ের আইসিটি প্রকল্পসমূহের মধ্যে ও ডিজিটালকরণ হয়েছে।যেমন – চট্রগ্রামের কাস্টমস্ এর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি, মোবাইল ব্যবহারের মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া, ডিজিটাল পাসপোর্ট পদ্ধতি এবং জাতীয় ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়ণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ডিজিটাল করণের ক্ষেত্রে সফলতা স্বাকর রেখেছে। তবু ও পরিপূর্ণ জ্ঞানভিওিক একটি সমাজ বির্নিমাণের বিষয়টি এখন ও অনেক দূরে রয়ে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পূর্বশর্তঃ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে পূর্বশর্ত হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তোলা। এ জন্য সর্বপ্রথম আমাদেরকে দেশের উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে। এরপর সকল ক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তির সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবারাহে ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে, ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধন করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্বায়নের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা অর্জনের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক বিদ্যমান। তাই ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা অর্জন ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সমস্যাসমূহঃ পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন প্রায় অর্ধেক । সর্বস্তরে ইন্টারনেট ব্যবহার ডিজিটাল বাস্তবায়নে একটি পূর্বশর্ত হলে ও বাংলাদেশের শতকার মাত্র ৩.৩ জন লোক এর আওতায় এসেছে । অথচ পাশর্^বর্তী দেশ ভারত এ হার ২৩.১% । অন্যদিকে বাংলাদেশের খুব কম মানুষই ইংরেজীতে যোগাযোগের দক্ষতা অর্জন করেছে। তাই এটি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা । সর্বোপরি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, ইন্টারনেট ও ইংরেজী শিক্ষা প্রসারের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, বাংলাদেশের মতো, একটি দরিদ্র দেশের জন্য তা এক কথায় অসম্ভব।
ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং অর্থনীতিতে ডিজিটাল করণের প্রভাবঃ ডিজিটালকরণের লক্ষ্য হলো মানুষের সর্ব্বোচ্চ উন্নয়নের মাধ্যমে একটি জ্ঞাননির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা । সে জন্য বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরুপে ডিজিটাল করণ করতে পারলে দেশের প্রতিটি মানুষ সচেতন ও প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠবে এবং কারিগরি জ্ঞানে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জন করতে পারবে। এর পরিপূর্ণ প্রভাব পড়বে সমাজ তথা দেশের উপর । আমাদের দেশের দক্ষ জনশক্তি তাদের প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উৎপাদন বহুগুনে বৃদ্ধি করতে পারবে এবং দেশীয় প্রাপ্ত সম্পদের সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে। এতে করে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে এবং ধীরে ধীরে দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হবে। ফলে দেশের মানুষ দুর্নীতি, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব, দারিদ্র, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতি সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। এভাবে ডিজিটাল করণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সবদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের উপায়ঃ প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান বিশ্বে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই আমাদেরকে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা বাস্তবায়ণে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হতে হবে । এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা। তাই দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশী বিনোয়োগকারীদের আমাদের বিদ্যুৎ, তথ্য ও যোগাযোগ খাতসহ সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্ঠা করতে হবে। এক কথায়, দেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, রাষ্ট্র পরিচালনা আমাদেরকে এমন নেতৃত্ব বেছে নিতে হবে যারা মনে প্রাণে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণাটি বিশ্বাস করে এবং সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাথে দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। অন্যদিকে, আমাদেরকে গ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশের গ্রাম তথা তৃণমূল পর্যায়ে বিদ্যৎতের সরবরাহ, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা গেলে ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন অনেকটাই এগিয়ে যাবে। সর্বোপরি, ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণাটি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের তরুণ সমাজকে নবোদ্যমে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
উপসংহারঃ ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটির মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে অপেক্ষাকৃত অধিক গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা মূলক একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন । এটি কোনো স্বল্পমেয়াদি প্রক্রিয়া নয়, বরং পরিবর্তনের একটি ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া । এজন্য আমাদের সকলের উচিত বাংলাদেশকে আধুনিক ও প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করা। প্রয়োজন হলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে মিল রেখে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন কৌশল পত্র ও পুননির্ধারণ করা। তাহলে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন সফল হবে আর বিশ^ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারবে।
Share This Post