রচনা(প্রবন্ধ)“সড়ক দূর্ঘটনা ও তার প্রতিকার”
সড়ক দূর্ঘটনা ও তার প্রতিকার
ভূমিকাঃ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রয়েছে বিভিন্নমুখী চাওয়া। আর এসব চাওয়া পাওয়ার সম্মিলন ঘটানোর প্রয়াসেই প্রতিটি সমর্থ ব্যক্তিকে প্রতিদিনই নাস্তা সেরে রাস্তায় নামতে হয় জীবিকার অন্বেষণে। রাতের নীরব রাস্তা সূর্য বাড়ার সাথে সাথে সরব হয়ে ওঠে পথিকের ব্যস্ত পদচারণায়, যানবাহনের হন চাকার ঘৃর্ণনে। কাজ শেষে সবাই ঘরে ফিরবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু মাঝে মাঝে এই স্বাভাবিকতায় বিঘ্ন ঘটায় সড়কে চলমান যন্ত্র দানবগুলো। এরা অকস্মাৎ ছিনিয়ে নেয় পরিবারে একমাত্র আশা , অন্নবস্ত্রের সংস্থান কারী যা কখনোই কাম্য নয়। লোকসংখ্যা ও যানবাহন বনাম রাস্তাঃ- স্বাধীন রাষ্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাংলাদেশের সড়ক পথের যথেষ্ট উন্নতি হলে ও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে বাংলাদেশে ২১ হাজার কিলোমিটার পাকা রাস্তা হয়েছে যার মধ্যে মাত্র ৪৮% হাইওয়ে সম্পন্ন । অপরদিকে, এ দেশে শুধু মোটর যানবাহনের সংখ্যাই প্রায় ৬ লক্ষ । রিক্সা,ভ্যান, সাইকেল, ঠেলা গাড়ি, অটোরিক্সা ইত্যাদি অগণিত। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উন্নত দেশের তুলনায় এগুলো আমাদের দেশে প্রায় ৩০ গুন বেশী। ফলে দেশের বৃহওম শহরগুলোতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্য বন্যার বেগে ছুটে আসা মানুষ আর যানবাহনের ভিড় ক্রমাগত বাড়ছে। শহর নগর বন্দর সবৃত্রই যেন ঠাঁই নেই অবস্থা। এ হিসেবে বাংলাদেশের সড়ক পথে অতিরিক্ত যানবাহনের ফলে দুর্ঘটনা হওয়া স্বাভাবিক।
সড়ক দূর্ঘটনার কারণঃ সড়ক দূর্ঘটনা বর্তমান আমাদের দেশের একটি জাতীয় সমস্যা। সাধারণত বেশির ভাগই দূর্ঘটনাই ঘটে অদক্ষ অযোগ্য লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে। দায়িত্বহীনতায় ও দূর্ঘটনা ঘটার একটি অন্যতম কারণ। নিজের ও যাত্রীদের মায়া না করে প্রায়ই চালকেরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায়, যা সম্পদ হানির পাশাপাশির প্রায়ই কিছু জীবনের যবনিকা টেনে দেয়। আবার ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল দূর্ঘটনার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। ট্রাফিক আইন ভঙ্গের মাধ্যমে ওভাওটেকংয়ের ভূত যেন প্রতিটি চালকের ঘাড়ে বিদ্যমান। এ বিচার বিবেচনাহীন ওভাবটেকিং অধিকাংশ দূর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণ। এ ছাড়া ও অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পথ অবরোধ, পথসভ্য, হরতাল প্রভৃতি কারণে যানজটের সৃষ্টির ফলে যানবাহনে নিয়ন্ত্রন কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া দূর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের সঠিক নীতিমাল আইন ও কানুন না থাকা, সড়কে প্রয়োজনীয় ফুটপাত ও ফুট ওভারব্রিজ না থাকা ও পথচারীদের অসতর্কতার কারণে ও সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। এক জরিপে দেখা গেছে,৯১ শতাংশ গাড়িচালক জেব্রা ক্রসিংয়ে অবস্থানরত পথচারীদের অধিকার আমলই দেয় না। পাশাপাশি ৮৪ শতাংশ পথচারী নিয়মবহির্ভূতভাবে রাস্তা পার হয়। এছাড়া শুধু ঢাকা শহরের ৯৪ ভাগই রিক্সাচালক ট্রাফিক আইন ও রাস্তার রিক্সা চালানোর প্রাথমিক নিয়ম কানুুন গুলো জানে না। যারা কিছু যানে না তারা অবলীলায় ও ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে, দ্রুত এবং দিগি¦দিক জ্ঞান শূণ্য হয়ে ছুটে চলে । এদের সুশৃঙ্খল অবস্থায় আনার মতো ট্রাফিক ব্যবস্থা এদেশে আজ ও গড়ে উঠেনি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সড়ক দূর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয় এবং এ দেশে সড়ক দূর্ঘটনা সংঘটিত হয় উন্নত দেশগুলোর চেয়ে ২৫ গুণ বেশী।
দূর্ঘটনা চিত্রঃ সড়ক দূর্ঘটনা বর্তমানে আমাদের দেশে নৈমিওিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। দেশের কোথা ও না কোথা ও সড়ক দূর্ঘটনা মুর্হূতের মধ্যে ছিনিয়ে নিয়েছে নিচ্ছে মানুষের অমূল্য জীবন, ভেঙ্গে দিচ্ছে অসংখ্যা সাজানো সংসার । পত্রিকার পাতা খুললেই আমরা দেখতে পাই দূর্ঘটনার খবর। স্বজনহারা মানুষের আহাজারি, পিতৃহারা সন্তানের আকুতি আর যেন কোনো সন্তানকে এতিম হতে না হয়। সরকারি হিসেবেই এ সংখ্যা বছরের প্রায় চরিশ। কোথা ও বাসের সাথে বাসে, কোথা ও বাসে ট্রাকে কোথা ও টেম্পু বাসে ঘটে এ দূর্ঘটনা । আবার কোথা ও রিক্সা বা নিরীহ পথচারীকে চাপা দেয় দ্রুতগামী বাস বা ট্রাকে, কেড়ে, নেয় অমূল্য জীবন।
ঢাকার চিত্রঃ ঢাকার বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। আয়তনের তুলনায় একানকার লোকসংখ্যা বেশী। দুই দেড় কোটি লোকের তুলনায় এখানকার রাস্তা বা রাস্তার যানবাহন মোটেই পর্যাপ্ত নয়। যানবাহনের যেগুলো আছে সেগুলো বেশিরভাগই জরাজীর্ণ সংর্কীণ চলাচলের অযোগ্য বা নিরাপদ সড়ক গঠনের অন্তরায় । ফলে বাড়ছে অসংখ্য দূর্ঘটনা পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যা।
ঢাকার বাইরের চিত্রঃ তুলনামূলকভাবে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরের দুর্ঘটনা হার কিছুটা কম। দূর পাল্লার বাস, ট্রাকই মূলত ট্রাকই এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয়। অনেক সময় ফেরিতে উঠতে গিয়ে বা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তার পাশের গাছে ধাক্কা খেয়ে, অথবা প্রতিযোগিতামূলক ভাবে কোনো গাড়িকে অবাকটেক করতে গিয়ে সংঘটিত অসংখ্যা দুর্ঘটনা অকালে অনেকের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতিঃ সড়ক দুর্ঘটনা শুধু মানুষের জীবন সংহারই নয়, বরং আর ও অনেক অপূরণীয় ক্ষতির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া মানুষের জীবনে । সড়ক দুর্ঘটনা আহত হয়ে অনেকে প্রাণে বেঁচে যায় বটে, কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক গতি তারা হারিয়ে ফেলে তারা চিরদিনের মতো । পঙ্গুত্ব শারীরিক বৈকল্য আর যন্ত্রণা আর আসহ্য ভার বহন করে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয় । বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের, যানবাহনের ও সমাজের যে সূদুরপ্রসারী ক্ষতি হয় তার আর্থিক হিসাব দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিকারঃ সড়ক দুর্ঘটনা নিঃশব্দ আততায়ীয় মতো আমাদের স্বজদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।প্রতিদিন অকালে ঝরে যাচ্ছে কত তাজা প্রাণ, কত ঘরে জমে বুক চাপা কান্না, কত পরিবারের বেঁচে থাকার আলো নিভে যায। কত মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে টুকরো হয়, তবু ও মানুষকে জীবন জীবিকার তাগিদে পথ চলতে হয়। অথচ এ পথের বলি ঠেকানো, পঙ্গুত্বকে এড়ানো অনেকটা আমাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। একটু সচেতনতা ধৈর্য সতর্কতা আর ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ সড়ক দুর্ঘটনা বহুকালে হ্রাস করতে পারে। এ জন্য লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতা ভালভাবে যাচাই বাচাই করতে হবে। লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে গাড়ি চালাতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পরিকল্পিত ট্রাফিক আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট প্রশস্ত করতে হবে। ভাঙা ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন যাতে রাস্তায় যাতে নামতে না পারে, সে জন্য কৃতপক্ষের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ড্রাইবারের পরিবর্তে হেলপারকে দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। গাড়ির ধারণ ক্ষমতা বাইরের মাল ও যাত্রী বহন বন্ধ রাখতে হবে। পুরানো রাস্তাঘাট মেরামত করতে হবে। বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতা ভিওিক গাড়ি চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। ট্রাফিক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দুর্ঘটনা রোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তাই প্রতিটি চালক এমনকি পথচারীকে ও ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে- সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
উপসংহারঃ কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মাউত-প্রতিটি জীবিত প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবে। আমাদেরও মরতে হবে। কিন্তু কেউই পথের বলি হয়ে মরতে চায় না । কিন্তু দেশের কোথায় ও না কোথায় ও সড়ক দুর্ঘটনা মুর্হূতের মধ্যে ছিনিয়ে নিচ্ছে মানুষের অমূল্য জীবন , ভেঙ্গে দিচ্ছে তাদের সাজানো সংসার । তাই সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে আমাদের দেশের একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ সর্বমহল থেকে তাই দাবি উঠেছে , নিরাপদ সড়ক চাই।
Share This Post