রচনা (প্রবন্ধ) “গ্রাম্য মেলা”
গ্রাম্য মেলা
ভূমিকাঃ গ্রাম্যবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম উপাদান গ্রাম্য মেলা।বিনোদনহীন নিরান্দন একঘেয়ে গ্রাম্যজীবনে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে মেলা।জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ সকল গ্রামবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন মখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। মানুষের সাথে মানুষের শিল্পের সাথে শিল্পীর এক অপূর্ব মেলাবন্ধন সৃষ্টি হয়। আর এভাবেই মেলা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।মেলা কীঃ- মেলা শব্দের অর্থ হল মিলিত হওয়া । সাধারণত বছরের শেষে অথবা শুরুতে নয়তো বিশেষ কোনো পর্ব উপলক্ষ্যে মানুষজন একটি বিশেষ স্থানে একত্রিত হয়ে নানা উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপিত একটি বিশেষ সম্মিলনকে মেল বলে।
মেলার উৎপওিঃ আদিম যুগে মানুষ অদৃশ্য দেবতা পুরুষকে বিশ্বাস করতো ,যা আদিমতম ধর্ম বিশ্বাস বা এনিমিস্টিক নামে পরিচিত। তৎকালিন সময়ে মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা এবং আরো অধিক পরিমাণে ফসল ও খাদ্য প্রাপ্তির জন্য দেবতা পুরুষের সহায়তা কামনা করতো। এ বিশ্বাস থেকে তারা যে দিন বার্ষিক ফসল পেতো সেদিন কোনো পাহাড় পর্বতের পাদদেশে, নদীর তীরে বা সুবৃহৎ বৃক্ষের শীতল ছায়ার সমবেত হতো। এ সকল স্থানে তারা নব ফসল সম্ভার, জীবজন্তু বা গৃহে প্রস্তুত দ্রব্য সামগ্রী উপঢৌকন দিতো। নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এ জমায়েত বা মিলন থেকে আধুনিক গ্রাম্য উৎপওি হয়েছে।
মেলার উপলক্ষঃ মেলা অনুষ্ঠানের জন্য সাধারণত বিশেষ উপলক্ষে কাজ করে। আবহমানকাল ধরে আয়োজিত গ্রাম্য মেলাগুলো সাধারণত দুই ধরনের উপলক্ষে নিয়ে আয়োজিত করা হয় । যথা- ধর্মীয়ঃ চেত্রসংক্রান্তির মেলা, রথযাত্রা মেলা, অষ্টমী মেলা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা মেলা, মাঘী পূর্ণিমা মেলা, কোনো লৌকিক দেবতা, দরবেশ, পীর বা সন্ন্যসীর নামে মেলা ইত্যাদি। ধর্ম নিরপেক্ষ বিভিন্ন লোকায়ত মেলা: নববর্ষ, পৌষ মেলা, নৌকা বাইচের মেলা, ঘোড়া দৌড়ের মেলা, লাঠিখেলার মেলা, পশুপ্রর্দশনীয় মেলা, ঘুড়ি উৎসবের মেলা, কুটির শিল্পের মেলা, বিভিন্ন খেলাধুলার মেলা, কুস্তি প্রতিযোগিতা মেলা ইত্যাদি। তা ছাড়া কোনো বিশেষ ব্যক্তি, কবি, সাহিত্যিক, নামে ও মেলার আয়োজন করা হয়। যেমন কবি জসীমউদ্দীন মেলা, লালন শাহ্ মেলা, মাইকেল মধুসূধন মেলা, বনলতা সেন মেলা ইত্যাদি। তা ছাড়া উপজাতিরা গ্রামের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে গ্রাম্য আয়োজন করে থাকে। তবে যে উপলক্ষেই আয়োজন করা হোক না কেন গ্রাম্য মেলা বাঙালি সমাজ ও মানুষের নিকট খুব জনপ্রিয় ও আনন্দের দিন। বাংলাদেশের প্রচলিত মেলাগুলো কোনটি একদিন কোনটি এক সপ্তাহ, কোনটি পনেরো দিন আবার কোনো মেলা মাস ব্যাপী চলতে থাকে।
মেলার স্থানঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মেলা বসে । মেলা বসার জন্য হাট বাজারের ন্যায় নিদিষ্ট কোন স্থান নির্ধারিত থাকে না। সাধারণত গ্রামের কেন্দ্রস্থলে খোলা মাঠে, মন্দির প্রাঙ্গণে,নদীর তীরে অথবা বড় বৃক্ষের নিচে গ্রাম্য মেলা বসতে দেখা যায়। পূর্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী এসব স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। এসব স্থানে সাময়িক ভাবে দোকানপাট বসার মত চালা নিমার্ণ করা হয়। মেলা শেষ হওয়ার পর ভেঙ্গে ফেলা হয়। বছরের শেষে মেলার আনন্দে আবার ও মুখরিত হয়ে উঠে মেলার সে স্থান।
মেলার প্রস্তুতিঃ- কোন দিন মেলা বসবে তা এলাকার লোকেরা আগে থেকে এবং সে অনুসারে তাদের প্রস্তুতি চলে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আগে থেকেই মেলায় খরচ করার জন্য তাদের পিতা মাতার নিকট থেকে টাকা পয়সা জমা করতে থাকে। এ ছাড়া আশে পাশের কারিগররা মেলায় বিক্রির জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরী করতে থাকে । তবে মেলায় বিক্রির জন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পছন্দের রং বেরঙের খেলনা তৈরিতেই বেশি মনোযোগ দেয় কারিগররা । যারা মেলায় মূূল আয়োজক তারা ও দীর্ঘদিন ধরে মেলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। মেলার মধ্যে নির্ধারিত স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, মেলার পরিবেশ সুশৃঙ্খলা রাখার জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা, দোকান বরাদ্দ দেওয়া, আগত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা সহ নানা ধরনের প্রস্তুতি তারা পূর্ব থেকেই নিয়ে থাকে।
মেলার বর্ণনাঃ গ্রাম্য মেলা বার্ষিক বাজার হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। মেলার দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী নিয়ে দোকানদাররা আসে। মেলায় দোকানগুলো সুশৃঙ্খল ভাবে সাজানো থাকে। মেলায় কোথা ও খেলনা, কোথাও ডালা কুলা চালুনি, কোথাও কাঠের জিনিসপত্র, কোথা ও ঘুড়ি এবং কোথা ও খাবারের জিনিসের দোকান বসে। এ ছাড়া কোনো কোনো মেলায় একপাশে নাগরদোলা, রাধাচক্রও সার্ক্রাস বসে। আবার অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলায় হাজির হয়। আশেপাশে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর কারিগররা যেসব জিনিস তৈরী করে, তা তারা বিক্রয়ের জন্য মেলায় নিয়ে আসে। এভাবে সুন্দন সুন্দর জিনিসের সমারোহে মেলাঙ্গনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। সেই সাথে থাকে মিষ্টি বিক্রয়ের আয়োজন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নানা রকম খেননা জিনিস। তাদের মুখের বাঁশির শব্দের চারদিকে মুখরিত হয়ে উঠে। মেলা উপলক্ষে আর ও বিচিত্র আনন্দের উপহার এখানে সমবেত হয়। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সেসব আনন্দ উপভোগ করে থাকে। মেলায় কিছু খেলাধুলার প্রতিযোগিতা ও চলে। এর মধ্যে হা ডু ডু ও কুস্তি প্রতিযোগিতা দর্শকদের বিশেষ আনন্দ দেয়।
মেলার তাৎপর্যঃ গ্রামীণ জীবনে মেলার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। গ্রামের মানুষ সারা বছর হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে । এ অমানুষিক পরিশ্রম কখনো কখনো তাদের জীবনযাপনের ছন্দপতন ঘটায়। কিন্তু মেলা গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে অনাবিল আনন্দের উৎস হিসেবে উদযাপিত হয়। গ্রামে উৎপাদিত বা তৈরী পণ্যসামগ্রী, নানা শিল্প সম্ভার মেলায় প্রদর্শিত হয়ে গ্রামীণ জীবনে ছবি স্পষ্ট করে তোলে। গ্রামীণ জীবনের নানা ঐতিহ্যের পরিচয় রূপায়িত হয় গ্রাম্য মেলার মাধ্যমে। গ্রামের নানা খেলা ও আমোদ প্রমোদের উপকরণ দেখতে পাওয়া যায় গ্রাম্য মেলায়। মেলায় মাধ্যমেই মূলত আমাদের প্রকৃত গ্রামীণ সংস্কৃতি আমাদের সামনে উন্মেচিত হয়। তা ছাড়া গ্রাম্য মেলাকে গ্রামীণ মানুষের মিলনের অন্যতম উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।বার্ষিক এ অনুষ্টানে বিভিন্ন গ্রামথেকে আগত নানা শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হয়। ফলে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ গড়ে উঠে।
মেলার উপকারিতাঃ গ্রাম্য মেলার অনেক উপকারিতা রয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম্য মেলা শুধু চিওের শান্তিই দেয় না, বিওের শক্তি ও যোগায়। মেলায় কৃষি ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি বেচাকেনা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের কামার- কুমার, তাঁতি, সুতারদের মধ্যে বিভিন্ন জিনিস বানানোর হিড়িক পড়ে যায়। তাই দেখা যায়, মেলার মাধ্যমে গ্রামীণ অনেক মানুষের কিছু উর্পাজনের পথ ও প্রশস্ত হয় । এ ছাড়া সার্কাস ও যাত্রাদলসহ আরো অনেকেই মেলায় ব্যবসায় করে থাকে। এতে করে বহু লোকের কিছুটা হলে ও অন্ন সংস্থান হয়।
মেলায় অপকারিতাঃ- গ্রাম্য মেলার অনেক উপকারিতা থাকা সত্বেও এর কিছ্টুা অপকারিতা ও রয়েছে। মেলায় বিচিত্র ধরনের লোকের সমাগম ঘটে। জুয়া, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অসামাজিক ও অন্যায় অবৈধ কাজ মেলায় সংঘটিত হয়ে থাকে। তা ছাড়া অনেক লোকের সমাগম হেতু পরিবেশ দূষিত হয়।
উপসংহারঃ কর্মব্যস্তার এ যুগে মানুষ গ্রাম্য মেলায় দিনগুলোতে আনন্দপ্লুত হয়ে নতুনভাবে কর্মপ্রেরণা লাভ করে থাকে। গ্রাম্য মেলা একাধারে যেমন আমাদের চিন্তা- চেতনা স্রােতকে অব্যাহত রাখে, তেমনি আমাদের ঐতিহ্য ও সামাজিক একাত্মতাকে যুগযুগ ধরে নিরবচ্ছিন্ন রাখে। তাই গ্রামীণ জীবনে তাৎপর্য বিবেচনা করে এর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে, যেন তা সকলের কাছেই উপভোগ্য হয়।
Share This Post